নাড়ির টানে বাড়ির পানে

ঈদ মানে ঘরে ফেরার উৎসব। দৈনন্দিন ব্যস্ততা ভুলে ঈদ আনন্দ উদযাপন করতে কয়েক দিনের জন্য বাড়ি ফেরেন সবাই, বাড়ি ফেরেন তারার ভুবনের মানুষেরাও। আপনজনের সান্নিধ্যে নিজস্ব নীড়ে এবার কেমন কেটেছে দুই তারকার ঈদ? তাঁদের মুখেই শোনা যাক সে গল্প...

জাহিদ হাসান ও ন্যান্সির ফাইল ছবি থেকে কোলাজ
জাহিদ হাসান ও ন্যান্সির ফাইল ছবি থেকে কোলাজ

পরিবারের সঙ্গে ঈদ
জাহিদ হাসান

ঈদের আনন্দের পূর্ণতা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমার বেলায় যা ঘটেছে, তা শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত একই রকম। মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করা—এ যেন পরম আনন্দ। অন্য রকম এক অনুভব। এখন তো বাবা নেই। শৈশবে বাবার সঙ্গে ঈদের স্মৃতিগুলো এখনো অনেক বেশি আবেগপ্রবণ করে তোলে।

আমরা পাঁচ ভাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন সবাই বড় হয়ে গেছি। নিজ নিজ কর্মব্যস্ততা নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছি বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু ঈদ এলেই সবাই ছুটে যাই মায়ের বুকে। পরিবারের সবাই একত্র হই একই ছাদের নিচে। মায়ের মমতার সংস্পর্শে। সবার মধ্যমণি হয়ে যান মা। এই আনন্দের অনুভব তো ভাষাহীন। শুধু কি তা-ই? সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ভাই-ভাবি ও ভাতিজাদের সঙ্গে মজার সব আড্ডা। আর পাড়ার বন্ধুবান্ধবের কথা তো আছেই। পাঠক, এবারের ঈদের স্মৃতি নিয়ে কথা বলা যাক। শুটিংয়ের ব্যস্ততার কারণে বাড়ি যেতে হলো ঈদের এক দিন আগে। তাই গরু কিনতে যাওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলাম। আমার বড় ভাই ড. ইউসুফই এবার গরু কিনলেন। কিন্তু বাড়ি যাব কীভাবে? একদিকে পূজা আর অন্যদিকে ঈদ। দুজন ড্রাইভারই চলে গেলেন ছুটিতে। অগত্যা নিজেকেই ড্রাইভ করতে হলো। রাত আটটার সময় রওনা দিলাম। কিন্তু পথে পথে তীব্র যানজট। আদৌ কি পৌঁছাতে পারব বাড়িতে? যতই সংশয় জাগছিল মনে, সাহস জোগাচ্ছিল মৌ। হঠাৎ গাড়ির চাকা পাংচার। রাত তখন ১২টা পেরিয়ে। মেরামত করব কীভাবে? সব দোকান তো বন্ধ। অনেক কষ্ট করে এই কাজটাও করতে হলো নিজেকে। অভিনেতার পরিচয়টুকুর কারণে আশপাশের মানুষ জড়ো হয়ে সাহায্য করল। তারপর আবার পথচলা। এদিকে বাড়ির সবাই তো অধির অপেক্ষায়। রাত দুটোর সময় গিয়ে পৌঁছালাম বাড়িতে। গাড়ির হর্ন বাজতেই হই-হুল্লোড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সবাই। মায়ের শুভ্র চেহারার সুন্দর হাসিমাখা মুখখানা দেখেই যেন ম্লান হয়ে গেল সব ক্লান্তি। মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতেই অনুভব করলাম মায়ের আদর স্নেহ ও মমতার পরশ।

এদিকে ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা তো অস্থির। কতক্ষণে চাচ্চুকে গরু দেখাবে। সবাই মিলে গরু দেখলাম। এবার তিনটি গরু কিনেছি। নিজেদের জন্য এবং গরিব-দুঃখীদের জন্য। গরু দেখতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে গেল শৈশবের একটি স্মৃতি। বাবা তখন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ছোট্ট একটি গরু কিনতে সবাই ছুটে যেতাম হাটে। আজ বড় বড় তিনটি গরু কিনেছি আমরা, কিন্তু নেই শুধু বাবা।

এবার ঈদের দিনের কথা বলি। ঈদের নামাজ পড়ে বাসায় আসতেই ভাইদের ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত চেয়ার, টুল আর মোড়া নিয়ে। কখন আমাকে বসতে দেবে। কতক্ষণে চাচ্চুর গালে চুমু খাবে। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, চুমু খেলেই পাবে ঈদের সালামি...হা হা হা। এরই মধ্যে উঠোন থেকে মাংস কাটার জন্য ডাক পড়ল আমার। প্রতি ঈদেই সবার সঙ্গে উঠোনে মাংস কাটি। কারণ, একটাই, কাজের ফাঁকে সবাই আমার মুখে নাটকের নানা মজার গল্প শুনতে ভালোবাসে। গ্রামের এই মানুষের সারল্য আর ভালোবাসা—সবকিছু যেন আমাকে অনেক বেশি ঋণী করে ফেলে।

বগুড়া থেকে প্রায় ছয় কিমি. ভেতরে নেয়ামতপুর। খুব কাছের এক বন্ধু মুর্তজার অনুরোধে ঈদের পরের দিন রওনা দিলাম সেখানে। সঙ্গে শৈশবের বন্ধুরা তোফা ভাই, বাবু, বাচ্চু, সেলিম, বাবু লাল—যাদের কথা না বললেই নয়। বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছাতেই অন্য রকম এক দৃশ্য। রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে গেল আমাকে দেখার জন্য। সারা দিন বেশ ভালো সময় কাটল সেখানে। কিন্তু ফেরার পথে তো শুরু হলো ভোগান্তি। গাড়িতে সমস্যা দেখা দিল। পথে পথে বারবার গাড়ি থামাতে হলো। লোকজনও জড়ো হয়ে যাচ্ছে আমাকে দেখার জন্য। সব মিলে মনে হচ্ছিল যেন নির্বাচনের প্রচারণায় নেমেছি। তারপর অবশেষে বাসায় ফেরা।

ঈদের সময় বাড়িতে আসা মানেই এভাবে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়ানো, আড্ডা, তাস খেলা। এসবের মধ্য দিয়েই কেটে যায় সময়। তবে একটা স্মৃতি খুব মনে রাখার মতো। রাতের বেলায় বাড়ির ছাদে ভাবিদের সঙ্গে চায়ের আড্ডা। সবার বায়না, আমার মুখে মজার মজার চুটকি শুনবে, নাটকের শুটিংয়ের গল্প শুনবে। তখন আসলে অন্য রকম এক অনুভব জাগে। আমাদের কাজগুলো যতটা-না নিজের জন্য করা, তার চেয়েও বেশি আসলে দর্শকদের জন্য। দর্শকদের ভালোবাসা তা-ই প্রমাণ করে। আরও অনেক কাজ করতে চাই। ভালো কাজ করতে চাই। সব কাজই প্রিয় দর্শক, স্বজন ও শুভাকাঙ্খীদের জন্য। আসলে এই ঈদের আনন্দ বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করে সবার আগ্রহের কারণে। কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা সবার জন্য।

অনুলিখন: সুজাত হোসেন

মাকে ছাড়া ঈদ কোনো ঈদ না

ন্যান্সি

আমার মেয়ে রোদেলা এবার কেজিতে। বলতে গেলে, ওকে আমি শুধু জন্মই দিয়েছি এবং গত ছয়টি বছর সময় পেলে ওকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, খেলনা কিনে দেওয়া, একটু আদর করা, পড়তে বসানো—এটুকুতেই মায়ের দায়িত্ব পালন শেষ করেছি। ওর প্রকৃত মায়ের ভূমিকা পালন করে ওকে সারাক্ষণ দেখেশুনে বেড়ে তুলেছেন যিনি, তিনি আমার মা। মা ছিলেন বলে আমাকে আর ওকে নিয়ে ভাবতে হয়নি, ইচ্ছামতো নিজের কাজ করতে পেরেছি। তিনি ছিলেন আমাদের পরিবারের নিয়ন্ত্রক। তিনি ছিলেন বলে দূরে থেকেও আমাদের তিন ভাইবোনের মাঝে একতা ছিল। গত বছর মা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। কেমন যেন একটা খাপছাড়া ভাব। এবারের ঈদটাকে তাই আর ঈদ বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছে, দায়সারাভাবে কর্তব্য পালনের এক উপলক্ষ মাত্র।

আমাদের নেত্রকোনার বাড়িটা এখন বেশির ভাগ সময়ই ফাঁকা পড়ে থাকে। প্রতিবার এখানে সবাই একসঙ্গে কোরবানি দিই, এবার তার ব্যতিক্রম করি কী করে? তাই মনের টানে বাড়ি যেতেই হলো। ওদিকে আমার স্বামী তো ওর বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। ওকে সঙ্গে নিয়ে গেলে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ঈদে একা হয়ে পড়বেন। তাই ওকে রেখেই আমাকে একা নেত্রকোনা যেতে হলো। গিয়ে দেখি, কিছু আর ভালো লাগে না! মা নেই, তাই যেন কিছু নেই। কোনো কিছুতে সমন্বয় নেই। আজ মা থাকলে হয়তো স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও বাবা-মা, ভাইদের সঙ্গে ঈদ করতে পারতাম। এ ধরনের ‘ম্যানেজ’ করার বিষয়গুলো মা ভালো জানতেন। আসলে সবাই একসঙ্গে ঈদ করার মজাটাই অন্য রকম।

এবার বাড়িতে তিনটা আলাদা কোরবানি হয়েছে। বাবা আগামী বছর অবসরে যাচ্ছেন। তিনি বাড়ি ফিরে তাঁর রোজগারের টাকায় কোরবানি দিলেন। আমরা তিন ভাইবোন। ছোট ভাই এবার এইচএসসি দেবে। বড় ভাই ভাবিকে নিয়ে কাজের ব্যস্ততা শেষে ঈদের আগের দিন এসে কীভাবে কী করবেন, তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বাড়িতে সবকিছু গোছানোর মতো কেউ নেই। এ অবস্থাতেই তাঁরাও আলাদা কোরবানি দিলেন। আরেকটা কোরবানি দিলাম আমি। কোরবানি শেষে ঈদের পরদিনই আবার যে যার মতো বাড়িটাকে খালি করে চলে এলাম। দেখুন, মা বেঁচে থাকলে এমনটি হতে দিতেন না। পরিবারের তিনজনই রোজগার করি, কিন্তু বাড়িতে কোরবানি হতো তিনজনের সমন্বয়ে একটি।

মা নেই বলে কোনো টিভি চ্যানেলেও গান গাইছি না এবার। বাড়ি সামলাব, নাকি ঈদ উদ্যাপন করব? সবকিছু মিলে সত্যি বলতে কি, ঈদকে ঈদ বলেই মনে হয়নি এবার। মা নেই বলে আগের মতো একতা নেই, নেই পরিবারের বাঁধন। মাকে ছাড়া ঈদ আমার কাছে কোনো ঈদই না। দুঃখের বিষয়, এখন থেকে প্রতিটি ঈদ আমাকে এভাবেই মাকে ছাড়া কাটাতে হবে!

অনুলিখন: দেব দুলাল গুহ