বন্ধুত্বের হয় না পদবি
ভাবনা, চিন্তা ও ভালোলাগার জায়গাগুলো এতটা মিলে যাবে, কেউই কখনো ভাবেননি। এসব চিন্তা মাথায় দানা বাঁধার আগে থেকেই বন্ধু তাঁরা। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বন্ধুত্ব, তবে সম্পর্কের দৃঢ় বাঁধুনিটা নিজেরাই দিয়েছেন, নিজেদের তাগিদে। আলী যাকের ও সারা যাকেরের ছেলে ইরেশ; খালেদ খান ও মিতা হকের মেয়ে জয়িতা এবং তারিক আনাম খান ও নিমা রহমানের ছেলে আরিক। তাঁদের বন্ধুত্ব ভিন্ন এক ঘরানার

জন্মের পর থেকে সম্পর্কের মায়াজালে জড়িয়ে পড়ে মানুষ। জন্মগতভাবেই সেই পরিচিত মুখগুলো নিয়েই গড়ে ওঠে তাদের পৃথিবী। কিন্তু বন্ধুরা থাকে সব বাঁধনের ঊর্ধ্বে। কোনো ধরাবাঁধা নেই। ভালো লাগে, তাই বন্ধুত্ব। তবে কিছু কিছু বন্ধুত্বের গল্প অন্য রকম। কবে প্রথম ‘ভাব’ বলে বন্ধু পাতা হলো, কবে প্রথম সৌজন্যবোধের জড়তা কাটিয়ে ওঠা হলো—এসব মনে থাকে না এ ধরনের বন্ধুত্বের বেলায়। শুধু মনে থাকে ‘আমরা বন্ধু’। এমনই তিন বন্ধুর নাম—ইরেশ, জয়িতা আর আরিক। যেন উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া তাঁদের বন্ধুত্ব। যা ছিল, আছে আর থাকবে।
বয়সে ইরেশ বড়। আর কাছাকাছি আরিক ও জয়িতা। তবে সংখ্যা দিয়ে হিসাব কষে তো আর বন্ধুত্ব হয় না। কেমন কেমন করে যেন হয়ে গেল সখ্য। তিনে মিলে প্রায়ই আড্ডা হয়। কিন্তু আড্ডার ক্ষেত্রেও আছে ভিন্নতা। ব্যস্ততার কারণে ম্যানুয়ালি না, ভার্চুয়াল আড্ডাটাই তাঁদের মধ্যে জমে বেশ। গান নিয়ে জম্পেশ আড্ডা বসে তাঁদের। এমনকি গান নিয়ে আছে মজার গল্পও। বছর দেড়-দুয়েক আগে নাকি ইরেশ আর আরিকের সংগীতগুরু হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল জয়িতার। বেশ জোর দিয়েই ইরেশ আর আরিক গান শেখানোর জন্য জয়িতাকে ধরেন। জয়িতার কাছ থেকে রবীন্দ্রসংগীত শিখবেন তাঁরা। কিন্তু জয়িতা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, ব্যস্ত দুই অভিনয়শিল্পীকে রবিঠাকুরের গান শেখাতে গেলে রাত-দিন এক করে দিতে হবে। কারণ, সংগীতের প্রতি ভালোবাসা এবং এ নিয়ে অগাধ জ্ঞান থাকলেও সময় কোথায় সাধনার? এর পরও লক্ষ্মী গুরুর মতো শিষ্যদের সংগীত শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন জয়িতা। ইরেশের শিক্ষাজীবন ছিল এক দিনের আর আরিকের দু-তিন দিনের হবে। এরপরই পাট চুকল রবীন্দ্রসংগীত শেখার।
তবে শেখা আর শেখানোর পর্ব ছাড়াও, সংগীত অনেক বড় ভূমিকা পালন করে এসেছে ইরেশ-জয়িতা-আরিকের বন্ধুত্বের গাঁটকে মজবুত করতে। ইরেশের ভাষায়, ‘আসলে এই গানের জন্যই আমার সঙ্গে জয়িতার কিংবা জয়িতার সঙ্গে আরিকের বন্ধুত্বটা এত গাঢ় হয়েছে। বয়সের ব্যবধান থাকার পরও আমরা এই একটা প্রসঙ্গে এসে সমমনা হয়ে ওঠি।’
একই ভাবনা আরিক ও জয়িতারও। মজার ঘটনা হলো, সংগীত নিয়ে ভাবনার মিল বলতে কিন্তু শুধু সমঝদার তাত্ত্বিক বোঝাপড়া নয়। জ্ঞান নিয়ে টুকটাক মজাও করেন তাঁরা। এই যেমন উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে গিয়েছিলেন ইরেশ-জয়িতা-আরিক। সেখানে ‘রুদ্রবীণা’র ধীর সুর নিয়ে মাস তিনেক ফোনে ফোনে ফোড়ন কেটেছেন এই তিন বন্ধু। একে অপরকে ফোন করেই সম্বোধনের শব্দটি ছিল ‘টিঁইয়াও’! এমনই নানা অহেতুক কার্যকলাপ ঘটান এই তিন বন্ধু।

অহেতুক কার্যকলাপের প্রসঙ্গ উঠতেই আরিকের মনে পড়ে যায় ছোটবেলার এক ঘটনার কথা। আরিক আর জয়িতার মধ্যে খোঁচাখুঁচির একটা প্রবণতা রয়েছে। বিষয়টি সরাসরিই স্বীকার করেছেন তিনি। জয়িতাকে খেপাতে আরিকের ভালোই লাগে। স্মৃতি হাতড়ে আরিক বলেন, ‘তখন আমার আর জয়িতার বয়স ১৩-১৪ কিংবা ১৫ হবে। মায়ের (নিমা রহমান) জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছিল জয়িতা। সে দরজায় নক করল। আমি করলাম কী দরজা খুলে ওকে দেখেই ওর নাকের ওপর আবার দরজা লাগিয়ে দিই। বেচারি কিছু সময় হতভম্ব হয়ে থাকে। এরপর সে আবার নক করে। এবার আমি জানতে চাই সে কেন এসেছে? জয়িতা জানায়, মাকে শাড়ি দিতে এসেছে সে। আমি তখন তার হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে আবার মুখের দরজা লাগিয়ে দিই। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, এ নিয়ে খেপেছে জয়িতা। তবে এটাই কিন্তু মজা ছিল।’
তবে ইরেশের সঙ্গে এমন মজা করা হয় না। ইরেশ তো স্বভাবসুলভভাবেই মজার মানুষ। সময় উপভোগ করার জন্য ইরেশের সঙ্গই যথেষ্ট আরিক আর জয়িতার বেলায়। ইরেশ আর আরিকের মধ্যে খেলা নিয়ে প্রচুর আলাপ-আলোচনা হয়। বিশেষ করে, ফুটবল নিয়ে হুল্লোড়টা একটু বেশি হয়। বন্ধুর পাশাপাশি তাঁরা প্রতিবেশীও, তাই মাঝেমধ্যে বড় কোনো ম্যাচ হলেই টিভির সামনে বসে পড়েন তাঁরা। শুধু কী বসে পড়া? খেলাপাগল ইরেশ নাকি একবার বাংলাদেশকে জেতানোর জন্য একটা চেয়ারে জিম্মি করা মানুষের মতো জোর করে বসিয়ে রেখেছিলেন আরিককে। কারণ, ইরেশের ধারণা ছিল, ওই চেয়ারে আরিক না বসলেই হারবে বাংলাদেশ। ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবল নিয়েও ইরেশ-আরিক মেতে থাকতে ভালোবাসেন। ইরেশ লিভারপুলের সমর্থক আর আরিক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের। খেলা নিয়ে তর্ক হয়, হয় মনমালিন্যও। তবে দিনের শেষে বন্ধুদের সঙ্গে মোটেও রেগে থাকা যায় না।
রাগ, তর্ক, বিতর্কের অবকাশ নেই ইরেশ-জয়িতার বেলায়। দিন কয়েক পর দেখা না হলেও, কথা নিয়মিতই হয় তাঁদের। নানাভাবে ইরেশ সাহস জোগান জয়িতাকে, তাঁর মুখে হাসি ফোটান তিনি। আবার জয়িতাও ইরেশের কথায় অনুপ্রেরণা খুঁজে পান। মাঝেমধ্যে বাস্তবতার কারণে ভেঙে পড়লে ইরেশ কাজ করে জয়িতার মন ভালো করার জাদুর মেশিনের মতো। যদি এক ইরেশের চেষ্টা কোনোভাবে ব্যর্থ হয়, তাহলে আরিকও যোগ দেন ইরেশের সঙ্গে। জয়িতাকে হাসানোর জন্য ইরেশ-আরিক কোনো পথই ফাঁকা রাখেন না।
বন্ধুত্বের এত এত গল্পের ভিড়ে হয়তো মনে হতে পারে ইরেশ-জয়িতা-আরিকের বন্ধুত্ব বুঝি সেই ছোটবেলা থেকেই। না, মোটেও না। অনেকটা সময় নিয়ে মনে করে আরিক জানান, বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয় বছর পাঁচেক আগে। হিসাব মিলিয়ে ইরেশও জানান একই কথা। আর জয়িতাও একমত হন ইরেশ ও আরিকের সঙ্গে। তিনজনই জানান, পরিবার কিংবা কাজের স্বার্থে নন, তাঁরা বন্ধু শুধুই ভালোলাগার তাগিদে। এখন খুব একটা দেখা হয় না, তবে এর পরও বন্ধুত্বের বাঁধনটা একেবারেই মজবুত। শেষ কথায় ইরেশ জানালেন, বাঁধনটাতে একটু চোখ বোলাতে হবে। বললেন, ‘অনেক দিন দেখা হয় না ওদের সঙ্গে। দেখি এ দফায় আর ব্যস্ততাকে প্রশ্রয় দেব না। ওদের সঙ্গে একটা আড্ডা জমাব খুব শিগগির।’