ববিতা অজ্ঞান হয়ে যেতেন

>

দুই সময়ের দুজন অভিনেত্রী। দুজনই অভিনয় করেছেন মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে। ববিতা মুঠোফোনে শোনালেন যুদ্ধের পরপরই শুটিংয়ের স্মৃতি। আর অপর্ণা ঘোষ শুটিং স্পটে বসে সরাসরি শোনালেন এই সময়ের চলচ্চিত্রে অভিনয়ের গল্প। দুজনের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন হাবিবুল্লাহ সিদ্দিক

ববিতা
ববিতা

ববিতা বললেন

ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত। ববিতার কাছ থেকে সময় মেলা ভার। আলোকচিত্রী নিয়ে তাঁর বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব শুরুতেই নাকচ করে দিলেন। কিন্তু থাকল কথা বলার সুযোগ। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একবিকেলে কথা হলো একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর সঙ্গে।
মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নিয়ে কথা। আমাদের আলোচনার মূল বিষয়ও ওটাই। গল্পটা শুরু করলেন জহির রায়হান পরিচালিত লেট দেয়ার বি লাইট দিয়ে, যে ছবিটি মুক্তি পায়নি। কিন্তু ববিতা যখন এই ছবি নিয়ে কথা বলছিলেন, জীবন্ত হয়ে উঠছিল সেই সময়ের স্মৃতি। উজ্জ্বল আলো হয়েই স্মৃতিগুলো জ্বলে উঠছিল লেট দেয়ার বি লাইট-এর। ‘লেট দেয়ার বি লাইট-এর শুটিং হয়েছে ১৯৭০ সালের দিকে। বেশির ভাগ শুটিংই বিরাট বিরাট সেট ফেলে এফডিসিতে করা হয়েছে। জহির ভাইয়ের কাজ মানে অনেক বড় আয়োজন।’
ওই সময়ের অবস্থা বর্ণনা করে বলেন, ‘১৯৭০ থেকেই দেশের অবস্থা যখন উত্তাল হতে লাগল, তখন যাতায়াতের পথে অনেক কিছু চোখে পড়ত। ওসব দেখে কিছু একটা টের পেতাম।’ মুক্তি না পাওয়ার আফসোস ফুটে উঠল ববিতার কথায়।

এখনো মুক্তি পায়নি ববিতা অভিনীত লেট দেয়ার বি লাইট ছবিটি
এখনো মুক্তি পায়নি ববিতা অভিনীত লেট দেয়ার বি লাইট ছবিটি


গল্প থামে না। লেট দেয়ার বি লাইটের পরেই আসে অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষীরকথা। সুভাষ দত্ত পরিচালিত এই ছবিটির পুরো শুটিং হয়েছে কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। যুদ্ধের পরপরই শুটিং। পুরো ক্যান্টনমেন্টে যুদ্ধের আবহ বিদ্যমান। বিভিন্ন জায়গায় মাইন পোঁতা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মানুষের কঙ্কাল। দেয়ালে দেয়ালে নানা আঁকিবুঁকি, লেখা। নানা আকুতি। এরই মধ্যে শুটিং করা একটা মানসিক ধকল সহ্য করার মতো। সেই ধকল সামলে নিয়েই শুটিং করেছেন সবাই।
ববিতা সেই সময়ের কথা মনে করে বলেন, ‘এসব দেখে কার না কান্না আসে। এমনও হয়েছে, শট শেষ, আমি হু হু করে কেঁদে চলেছি। অনেকক্ষণ পরে হয়তো পরিচালক এসে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে থামিয়েছেন। আমার চরিত্রে কান্নার দৃশ্যে শুটিং করতে কোনো গ্লিসারিন লাগেনি। মাঝেমধ্যে শট দিতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতাম। তখন মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফেরাতে হতো। প্রায় মাস খানেক ওখানে শুটিং চলেছে। প্রতিটা দিন কী যে খারাপ লাগত।’
কথা বলতে বলতে আলোর মিছিল-এরপ্রসঙ্গও এল। সেই গল্পটা শোনালেন ববিতা। ‘আমাকে শুরুতে এই ছবিটি করতে অনেকেই মানা করেছিলেন। কারণ, এখানে রাজ্জাক সাহেবের ভাগনির চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। তখন আমরা তুমুল জনপ্রিয় জুটি। কিন্তু হুট করে মামা-ভাগনি হয়ে গেলে দর্শক কীভাবে নেয়, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল অনেকেই।’
সেই শঙ্কাটা অমূলক হয়েছে ছবি মুক্তির পর। মুক্তিযুদ্ধের এই ছবিটি তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল ওই সময়।

অপর্ণা
অপর্ণা

অপর্ণা বললেন

বিকেল চারটার ফ্লাইটে চট্টগ্রাম যাওয়ার তাড়া। যা করার এর আগেই করতে হবে। এমন তাড়া আগেই দিয়ে রেখেছিলেন অভিনয়শিল্পী অপর্ণা ঘোষ। বাধ্য হয়ে ঢাকা থেকে উত্তরার যানজট ও দূরত্ব ‘থোড়াই কেয়ার’ করে গত রোববার পৌঁছানো গেল নির্দিষ্ট শুটিংবাড়িতে। সেখানে একটি ধারাবাহিকের শুটিং করছিলেন অপর্ণা। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বসলেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
এরই মধ্যে ছয়টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। যার দুটিই মুক্তিযুদ্ধের। একটু ভিন্ন ধরনের গল্প এবং অন্য রকম চরিত্র—এই দুই ভাবনা যখনই মাথায় এসেছে পরিচালকদের, তখনই সামনে চলে এসেছে অপর্ণা ঘোষের মুখ। কারণ কী?
এই রহস্য উন্মোচনের দায়ভার পরিচালকদের ওপর ছেড়ে দিলেন এ অভিনেত্রী। তবে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে অভিনয় করার অনুভূতিও বলতে ভুললেন না। ‘এই অনুভূতি আসলে বোঝানো যায় না। ওই সময় সবার কষ্টগুলো অনুভব করার চেষ্টা করি। সেটাই নিয়ে আসি চরিত্রগুলিতে।’
কিছুদিন আগে জাহিদুর রহিম অঞ্জন পরিচালিত মেঘমল্লার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের গল্পে অভিনয় শুরু হয়েছিল তরুণ
প্রজ​েন্মর অভিনয়শিল্পী অপর্ণার। কে জানে এ কারণেই হয়তো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প ‘রেইনকোট’ অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটিকেই এগিয়ে রাখলেন তিনি।
তবে বেশি ছুঁয়ে গেছে ভুবন মাঝি চলচ্চিত্রের ফরিদা চরিত্রটি। আগামীকাল যে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাচ্ছে। ফাখরুল আরেফীন পরিচালিত এই ছবিটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে।
অপর্ণার কাছে এই চরিত্রটি একটা জীবন্ত চরিত্র হয়ে গেছে। যে ফরিদা হয়ে তিনি বড় পর্দায় হাজির হয়েছেন, সেই ফরিদা এখনো জীবিত। যাঁর সঙ্গে শুটিংয়ের আগেই কাটিয়েছেন অনেকটা সময়। জেনেছেন ওই সময়ের গল্প। একজন ফরিদা হয়ে ওঠা সহজ হয়েছে এ কারণেই।
জীবিত ফরিদার কথা বলতে গিয়ে চোখেমুখে আনন্দ খেলে গেল অপর্ণার। সেই আনন্দের রেশ থাকতে থাকতে বলেন, ‘আমার আর ফরিদার মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হলো, ১৯৭১-এ ফরিদা থিয়েটার করত, আমি এখন থিয়েটার করি। এ কারণে আমি খুব সহজেই চরিত্রটা অনুভব করতে পেরেছি। জানেন, এই ফরিদার গল্প ১৯৭১ থেকে শুরু হয়ে ২০১৩ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। আমি যখন বয়সী চরিত্রে অভিনয় করেছি, তখন এখনকার ফরিদাকে মনে করে শট দিয়েছি।’

ভুবন মাঝি ছবিতে কলকাতার পরমব্রতের সঙ্গে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের অপর্ণা ঘোষ
ভুবন মাঝি ছবিতে কলকাতার পরমব্রতের সঙ্গে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের অপর্ণা ঘোষ



ভুবন মাঝি নিয়ে কথা শেষ করার আগে বলেন, ‘মানুষের চরিত্রে ঢুকতে সমস্যা হয়। আমার ফরিদা থেকে বের হতে সময় লেগেছে। শট শেষ, শুটিং শেষ কিন্তু আমি এখন ফরিদাকে বহন করে চলেছি। এই অনুভূতি শুধু একটা ছবিতে তুলে আনা কঠিন।’