বাংলার নাচ আর বাংলায় নেই

নৃত্য উৎসবের নেপথ্যের ঐতিহাসিক মন্দিরের সামনে ‘আয় আমাদের অঙ্গনে’ নৃত্যনাট্যের পোশাকে সাধনার শিল্পীরা। ছবি: প্রথম আলো
নৃত্য উৎসবের নেপথ্যের ঐতিহাসিক মন্দিরের সামনে ‘আয় আমাদের অঙ্গনে’ নৃত্যনাট্যের পোশাকে সাধনার শিল্পীরা। ছবি: প্রথম আলো

আধো অন্ধকারে পাশে বসা মানুষটিকে দেখে চমকে গেলাম! শাস্ত্রীয় নৃত্যের খ্যাতিমান সমালোচক সুনীল কোঠারির পাশে বসে নাচ দেখা, যেকোনো নৃত্যপ্রেমীর জন্য অভাবনীয়। তাঁর সম্পর্কে যা কিছু জানা-পড়ার ঋণ, ওই গুগলের কাছে। নৃত্যশিল্পীদের স্বপ্ন থাকে, সুনীল কোঠারি তাঁকে নিয়ে দুকথা লিখুন। তাঁরই ডানপাশে বসেছে বাংলাদেশের তরুণ দুই শিল্পী অপর্ণা নিশি ও প্রজ্ঞা প্রতীতি। বলেই বসল, ‘দাদা, একটা সেলফি তুলি?’

গেল রোববার সন্ধ্যায় ভরতনাট্যম দেখতে দেখতে অন্ধকারেই নোট নিচ্ছিলেন সুনীল কোঠারি। মঞ্চ থেকে ছলকে আসা সামান্য আলোই যথেষ্ট প্রাজ্ঞ মানুষটির। টুকে নিতে নিতে হঠাৎ শুরু করলেন উচ্ছ্বসিত করতালি। মঞ্চের চূড়ায় তখন ঢাকার অমিত চৌধুরী, শেষ করলেন বিষ্ণুর কাহিনি ‘বর্ণন’। বাংলাদেশের নাচের দল কল্পতরুর ভরতনাট্যমের একটি পরিবেশনা সেটি। সবটা শেষ হলে দর্শকসারিতে খুব সন্তর্পণে চোখ মুছতে দেখা গেছে সাধনার শিল্পনির্দেশক লুবনা মারিয়ামকে। কেন? সেসব থাকুক।

শেষ হলো ৪৩তম ‘খাজুরাহো নৃত্য উৎসব’। ভারতের মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো শহরে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে সপ্তাহব্যাপী আন্তর্জাতিক এক উৎসব। এবার অতিথি রাষ্ট্র হয়ে এ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে অনেক কিছু। এ নৃত্যযাত্রায় অসাধারণ সব পরিবেশনার মধ্য দিয়ে দেশটিকে জানতে পেরেছে বিশ্ব। বেশ কয়েকটি দেশের শিল্পীরা যেতে চেয়েছেন বাংলাদেশে। সেখানকার শিল্পচর্চা আরও কাছ থেকে দেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছে তাঁদের। বিশ্বখ্যাত তরুণ কত্থকশিল্পী অনুজ মিশ্র তো বাংলাদেশের মঞ্চে নাচ করারও আগ্রহ দেখিয়েছেন। এসবই দেশের নৃত্যাঙ্গন ও উৎসবে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি শিল্পীদের জন্য বিরাট প্রাপ্তি। এ জন্য সাধুবাদ দিতে হয় সাধনার তিন কোরিওগ্রাফার সাব্বির আহমেদ খান, সুইটি দাস চৌধুরী ও অমিত চৌধুরীকে। ভোপালের ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সংগীত ও কলা একাডেমিকেও সাধুবাদ জানাতে হয় ‘অতিথি রাষ্ট্র’ হিসেবে বাংলাদেশকে মনোনীত করার জন্য।

ভারতে নিয়ম করে শুধু শাস্ত্রীয় নাচের উৎসবই হয় না। বলিউডের কতিপয় চলচ্চিত্রে এর ব্যবহারই বলে দেয়, নাচটিকে বিশ্বদরবারে জনপ্রিয় করতে তারা বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশে এর চর্চা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার মতোই বলে মনে করেন ঢাকার অনেক নৃত্যশিক্ষক ও শিল্পী। শাস্ত্রীয় নৃত্যের আন্তর্জাতিক মঞ্চে শুদ্ধ ভরতনাট্যম উপস্থাপন করে সেটি আবারও প্রমাণ করেছে কল্পতরুর চৌকস দলটি। বাংলার নাচ এখন আর বাংলায় নেই। বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে।

নীরবে শাস্ত্রীয় নৃত্যের চর্চা করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের বহু তরুণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেদের প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছেন তাঁরা। ঢাকায় শাস্ত্রীয় সংগীতের অনেক বড় একটি আন্তর্জাতিক উৎসব হয়। ইতিমধ্যে পৃথিবীর কাছে এর পরিচিতি ও সমাদর তৈরি হয়েছে। একই মানের একটি আন্তর্জাতিক শাস্ত্রীয় নাচের আসর এখন সময়ের দাবি।