মনোসরণির দিকে

মনোসরণি ব্যান্ডদলের সদস্যরা: প্রবর রিপন, তাসবীহ প্রসূন, মুয়ীজ মাহফুজ (বসে)। রাহিন ও বাঁধন (দাঁড়িয়ে)। ছবি: খালেদ সরকার
মনোসরণি ব্যান্ডদলের সদস্যরা: প্রবর রিপন, তাসবীহ প্রসূন, মুয়ীজ মাহফুজ (বসে)। রাহিন ও বাঁধন (দাঁড়িয়ে)। ছবি: খালেদ সরকার

তাঁদের জীবনটা খুব বড় নয়। কিন্তু এই জীবনে তাঁদের স্থিরতা এসেছে কমই। গানের জন্য কম মুল্লুক তো ঘোরা হয়নি—অসংখ্য স্যান্ডেলের সুকতলা ক্ষয় হয়েছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে একাধিকবার। এমনকি করতে হয়েছে রেস্টুরেন্টের ওয়েটারগিরি। তবে এত কিছুর পর ব্যান্ড দল মনোসরণির প্রথম অ্যালবাম দলের সদস্যদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পাশে যেন ঠান্ডা বাতাসের দোলা। দলের সঙ্গে মিলিয়ে তাঁদের অ্যালবামের নামও মনোসরণি, বেরিয়েছে বেঙ্গল মিউজিক থেকে। 
মনোসরণির সদস্যদের চিন্তা ও অ্যালবামের গানে যেন নিজেদের মুদ্রাদোষে কেবলই আলাদা হওয়ার তাগিদ। সেদিন বিকেলে হাতিরঝিলের সবুজ ঘাসের ওপর আমাদের সঙ্গে আড্ডাবাজির মুহূর্তেও সেটি গোপন থাকেনি।
ব্যান্ডের পাঁচ সদস্য প্রবর রিপন, মুয়ীজ মাহফুজ, বাঁধন, তাসবীহ প্রসূন ও রাহিন বসে আছেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
‘২০০৪ সালে আমি আর মুয়ীজ—দু-বন্ধু মিলে ব্যান্ডটা গঠন করি। আমরা দুজনই কবিতা লিখি। তো, সে সময় কবিতা লিখতে লিখতে আমাদের মনে হলো, কবিতায় কবি ভেদে তো একটা আলাদা সুর ও স্বর আছে; কিন্তু গান—বিশেষত আমাদের দেশের ব্যান্ডের গান, কেন জানি না আমাদের কাছে একই রকম মনে হতো—সবার গানই এক রকম। তাই নতুনভাবে, নতুন চিন্তায় গান করার জন্যই দল বাঁধলাম।’—নিজেদের শুরুর সময়ের কথা রিপন বলে গেলেন এক দমে।
মুয়ীজ সেখানে যোগ করলেন আরও কয়েক লাইন, ‘প্রথমে আমাদের ব্যান্ডের কোনো নাম ছিল না—রাস্তাঘাট, এখানে-সেখানে মনের আনন্দে গান গাইতাম। আর সে সময় তো আমাদের নিজেদের গান তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। সারাক্ষণই তাই কবীর সুমন, বব ডিলান—এঁদের গান লেগে থাকত গলায়। প্রথমে ছিলাম দুজন—আমি ও রিপন। তারপরে একে একে পাঁচ সদস্য—পঞ্চপাণ্ডব।’
কথা বলতে বলতে মুয়ীজ তাকালেন অন্য তিন সদস্যের দিকে। তখন তিনজনই সায় দিলেন তাঁর কথায়। যেমন বাঁধন বললেন, ‘গানের টানেই ওদের সঙ্গে পরিচয়। তবে সেই পরিচয় গাঢ় হতে একদমই সময় লাগেনি। কারণ, গানে আমিও নতুন কিছু করতে চাইছিলাম।’
এতক্ষণ গিটারে টুংটাং করছিলেন তাসবীহ প্রসূন। আগে তিনি বাজাতেন লীলা ব্যান্ডে। এরপর আরও বেশি মনের মিল খুঁজে পেলেন মনোসরণিতে। বললেন, ‘এখানে আমরা সংগীতের সব ধারা—ব্লুজ, জ্যাজ, রক, সাইকেডেলিক—সবকিছুকে মিলিয়ে মিশিয়ে কাজ করছি। তাই মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমাদের গানে বুঝি অনেক নদীর মোহনা আছে।’
‘নিজের ঢোল একটু বেশি পেটানো হয়ে গেল না? বেশি পেটালে ফেটে যাবে তো!’—বন্ধু প্রসূনের কথায় হঠাৎই ফোড়ন কাটলেন রাহিদ। হ্যাঁ, তাঁরা বন্ধুই বটে। মনোসরণিতে যোগ দেওয়ার আগে থেকেই তাঁরা বন্ধু। আর বন্ধুত্বের সূত্র? অবশ্যই গান।
বন্ধুত্বের এত তেজ যে ব্যান্ডে, তাঁদের অ্যালবাম করতে এত দেরি?
‘অ্যালবামের কাজ আসলে আমরা শুরু করেছিলাম ২০০৯-এ। কিন্তু নানা কারণে কাজটি শেষ করতে পারছিলাম না।’—আবারও রিপন কথা বলছেন। ‘প্রথম যখন শুরু করেছিলাম, আমাদের হাতে টাকাকড়ি তেমন ছিল না। গানের যন্ত্রপাতিরও অভাব ছিল। গান রেকর্ডের পর দেখা গেল, সাউন্ড ভালো হচ্ছে না, তেলে-জলে মিশ খাচ্ছে না ঠিকমতো। ফলে ছয়-সাত মাস কাজ করার পর সেটি বাতিল করে আবার নতুনভাবে শুরু করলাম সবকিছু।’
রিপনের কথা শুনে এ সময় মুয়ীজের কণ্ঠেও কথা, ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার।’
হ্যাঁ, আদতেই তাই। কারণ, ২০১০-এ যে জীবন ফড়িঙের শিরোনামে টেলিছবিতে একসঙ্গে মনোসরণির তিনটি গান ব্যবহূত হয়। সে সময় তাঁদের নতুন ধরনের কথা ও সুরের গানে খানিক চমকে উঠেছিলেন ব্যান্ড জগতের কেউ কেউ। কিন্তু তাঁরা তখন অ্যালবাম বের করেননি।
অ্যালবামের কাজে হাত দিয়ে প্রথমবার যে ব্যর্থ হয়েছিলেন, পারেননি, এ ব্যর্থতা থেকে তাঁরা শিখেছেন; শিখেছেন কোনো একটি কাজ করার আগে কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়। ফলে প্রথম অ্যালবামের ১২টি গানে রয়েছে সেই প্রস্তুতির আঁচ।
কে জানে নিজেদের এই ব্যর্থতা ও প্রস্তুতিই মনোসরণিকে অনেক দূর নিয়ে যায় কি না।