মুক্তির গান ছবির দেবু চৌধুরী

দেবু চৌধুরী ছবি: জাহিদুল করিম
দেবু চৌধুরী ছবি: জাহিদুল করিম

দেবু চৌধুরী। দেশের শীর্ষ তবলাশিল্পীদের একজন। মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের মুক্তির গান-এ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার যে দলকে ট্রাকে চড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে, শরণার্থী শিবিরে গিয়ে গান গাইতে দেখা গেছে, সেই দলে তিনি ছিলেন খোলবাদক। শুনি তাঁর কাছে সেই গল্প।
‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমরা থাকতাম চট্টগ্রাম খাতুনগঞ্জের রামজয় মহাজন লেনে। এক সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের নেতারা মিটিংয়ে বসলেন। জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম এ হান্নান, এম এ আজিজ, মোজাফফর সাহেব, প্রফেসর খালেকসহ আরও অনেকে। আমার বাবা মতিলাল চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রাম রাউজান থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। নির্বাচনে ওই এলাকায় মুসলিম লীগ কখনো সুবিধা করতে পারেনি। তাই বাবার ওপর তাদের অনেক ক্ষোভ ছিল। মিটিংয়ে সবাই বাবাকে বললেন তাঁর পরিবারকে গ্রামের বাড়ি রাউজানে পাঠিয়ে দিতে। বাবার একটা জিপ ছিল। পরদিন সেই গাড়িতে আমরা গ্রামের বাড়ি চলে গেলাম। কিন্তু বাবা যাননি। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর লোকেরা আমার বাবাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। এক সপ্তাহ পর আমরা খবর পেলাম বাবা নিখোঁজ। বাবার লাশটাও আর কোনো দিন আমরা পাইনি।’ বলছিলেন শহীদ মতিলাল চৌধুরীর ছেলে দেবু চৌধুরী।
এরপর তিনি শোনান মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থায় যোগ দেওয়ার গল্প।
‘বাবার বাড়ি রাউজান থানার আন্ধার মানিক গ্রামে। এপ্রিলেই রাজাকাররা আমাদের বাড়িটি জ্বালিয়ে দিল। আমরা তিন ভাই পালিয়ে রামগড় সীমানা দিয়ে মুক্তাঞ্চল হয়ে ত্রিপুরা চলে এলাম। মনে আছে, পথে পাকসেনাদের মুখোমুখি পড়ে যাই। আমরা কাদাপানির ধানখেতে লুকিয়ে পড়ি। জোঁকের কামড় খেয়ে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকি। সন্ধ্যায় ত্রিপুরা থেকে মালবাহী ট্রেনে চড়ে শিয়ালদহ চলে আসি। তারপর সেখান থেকে বালিগঞ্জে আমার জ্যাঠার বাড়ি। এখানেই দেখা হয় প্রবাল চৌধুরী ও কল্যাণী ঘোষের সঙ্গে। তাঁরা আমাকে বললেন বসে না থেকে ১৪৪ লেলিন সরণিতে চলে যেতে। আমি চলে গেলাম ওই ঠিকানায়। বাংলাদেশ থেকে এসে সেখানে জড়ো হয়েছেন শীর্ষ কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, নাট্যশিল্পীরা। সবাই সন্জীদা খাতুনের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থায় যোগ দিয়েছেন। আর এই দলের সবকিছু দেখভাল করতেন কলকাতা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পাপেটশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারও সেখানে ছিলেন। তখন দুটি দলে ভাগ করা হয় আমাদের। একদল বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান গাইত। আর একদল প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে মাহমুদুর রহমান বেণুর নেতৃত্বে লেলিন সরণিতে উদ্দীপনামূলক জগরণী গানের মহড়া করত। আমি এই দলে তবলা বাজাতাম। গানগুলোর মধ্যে ছিল, ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমার’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’, ‘ঢাক ওরে মুখচন্দ্র মা’সহ আরও অনেক গান। এই গানগুলো বালিগঞ্জ টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে আমাদের নিয়ে রেকর্ড করানো হয়। পরবর্তী সময়ে গানগুলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রচার করা হতো। এরপর সিদ্ধান্ত হলো, মুক্তিযোদ্ধা আর শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। আমরা মাহমুদুর রহমান বেণুর নেতৃত্বে বেরিয়ে পড়লাম। গানের দলে ছিলেন লুবণা মারিয়াম, শাহীন সামাদ, নায়লা খান, স্বপন চৌধুরী, ডালিয়া নওশীন, শারমীন মোর্শেদ, বিপুল ভট্টাচার্য, তারেক আলী, দুলাল শীল। মনে আছে, ছোট একটি ট্রাক ছিল আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ওটাতে চড়ে আমরা দিল্লি, শান্তিনিকেতন, দুর্গাপুর মুক্তাঞ্চলে রাস্তাঘাটে গিয়ে গান করে টাকা তুলতাম। ওই ট্রাকেই আমাদের থাকা-খাওয়া চলত। আমি এই দলে খোল বাজাতাম। প্রতিদিন আমরা ভাতা পেতাম এক টাকা। এর পঞ্চাশ পয়সা চলে যেত খাবারে। আমরা যখন বিভিন্ন জায়গায় উদ্দীপনামূলক গান করতাম, তখন বেণুদার অনুমতি নিয়েই তিনজন আমেরিকান দুটো ছোট মাইক্রোবাসে চড়ে আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড তাঁদের ক্যামেরায় (পরবর্তী সময়ে এই ফুটেজ থেকেই নির্মিত মুক্তির গান) ধারণ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সীমান্ত পেরিয়ে দুটি নৌকায় আড়াআড়ি করে ট্রাকটি তুলে নদী পার হয়ে ২৬ ডিসেম্বর রাজশাহী আমরা পৌঁছাই। সেখানে অস্ত্রসজ্জিত শত শত মুক্তিযোদ্ধা। আমরা ট্রাকের পেছনের ডালা ফেলে গান ধরলাম। একজন ব্রিগেডিয়ার আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।’
এরপর মুক্তির গান-এর খোলবাদক দেবু চৌধুরীর তবলাশিল্পী হয়ে ওঠার গল্পটা বলেন।
‘আমার বয়স তখন চার বছর। বাড়িতে অষ্টপ্রহর নামকীর্তন হতো। কীর্তন হতো খোল বাজিয়ে। আমিও সুযোগ পেলে হাঁটু গেড়ে খোল বাজাতে চেষ্টা করতাম। এটা বাবার চোখে পড়ল। একদিন তিনি আমাকে তবলা কিনে দিলেন। আমার তবলায় হাতেখড়ি পণ্ডিত কানাইলাল দাসের কাছে, যিনি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গে পাখওয়াজ বাজাতেন। ১৯৭০ সালে পিটিসির (পাকিস্তান টোব্যাকো কোম্পানি) একটি অনুষ্ঠানে প্রথম বাজাই। ওই অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন আবদুল আলীম, মাহমুদুন নবী, এম এ হামিদ, নীনা হামিদ, আবদুর রউফের মতো নামীদামি শিল্পীরা। সেদিন সারা রাত বাজিয়ে সম্মানী পেয়েছিলাম ১০ টাকা। তবে আমার যখন আট-নয় বছর, তখন থেকেই আমি চট্টগ্রাম বেতারের ‘শিশুমহল’ অনুষ্ঠানে বাজাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আমি বাংলাদেশ বেতারের শাহবাগ হোম সার্ভিস, পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত যন্ত্রশিল্পী হিসেবে বাজাতে শুরু করি। চলচ্চিত্রে আমি প্রথম কাজ করি সত্য সাহার সুরে গরমিল ছবির মোহাম্মদ খুরশিদ আলমের গাওয়া ‘রূপ দেখে বলব কী’ এই গানে। গানটি এফডিসিতে রেকর্ডিং হয়েছিল। আর বিটিভিতে ‘সুরবিতান’ অনুষ্ঠানে প্রথম সাইফুল ইসলামের দুটি গানে তবলা বাজাই। গান দুটি হলো ‘সোনার কাঠি রুপোর কাঠি’ এবং ‘তুমি সন্ধ্যাকাশে তারার মতো আমার মনে জ্বলবে’।
দেবু চৌধুরীর বাজানো বিখ্যাত গানের মধ্যে আরও রয়েছে ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে,’ ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘ও আমার রসিয়া বন্ধুরে’, ‘এক হৃদয়হীনার কাছে’ ‘বৈশাখী মেঘের কাছে’, ‘বাড়ির মানুষ কয় আমায় তাবিজ করেছে’, ‘ইস্টিশনের রেলগাড়িটা’, ‘বুকে আমার আগুন জ্বলে’ ‘কে বলে মানুষ মরে’ ইত্যাদি।
বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ফোরামের সাধারণ সম্পাদক দেবু চৌধুরী দেশের বাইরে অসংখ্য গুণী শিল্পীর সঙ্গে তবলা সংগত করেছেন। এই তালিকায় রয়েছেন মেহেদী হাসান, গোলাম আলী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখার্জি, জগজিৎ সিং, হরিহরণ, হৈমন্তী শুক্লা, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ।