যেমন ছিল লোকসংগীত উৎসব

শহরের ব্যস্ত এক সড়কের পাশে সুবিশাল খেলার মাঠ। বাউল আখড়ার গান নিয়ে সেখানে উৎসব। সেটাকে একটা আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়া হলো। বেশ কয়েকটি দেশ থেকে এসে গাইলেন সেখানকার লোকগানের শিল্পীরা। নিয়ে গেলেন মাঠভর্তি শ্রোতার প্রীতি। কৈলাস খের বলছিলেন, শিল্পী চায় নিজেকে তুলে ধরে সমাদৃত হতে। শহরবাসের দীর্ঘ ক্লান্তি হটাতে শ্রোতাদের দরকার প্রাণের গান। ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবের দ্বিতীয় আয়োজন কি খানিকটা তৃষ্ণা মেটাতে পারল দেশের মানুষের?

প্রথম রাতটি মমতাজের
বাংলার লোকসংগীতের সম্রাজ্ঞী মমতাজ তাঁর সেরা পরিবেশনাটি সম্ভবত করেছেন এই উৎসবে। শুরুতেই তিনি গেয়ে শোনান ফকির কালু শাহের ধীর তালের ‘ভুইলো না মন তাহারে’ গানটি। পরে শোনান ‘মন মিনারায় পড়েছে আজান’। তবে শেষ দিকে রীতিমতো উত্তাল হয়ে ওঠেন শ্রোতারা। নাচতে শুরু করেন ‘খাজা মরে নাই’ ও ‘মানুষ রাখসে নাম’ গানের সঙ্গে সঙ্গে।
দ্বিতীয় দিন ছিল কৈলাস রজনী
‘আওজি’, ‘ও পিয়া পিয়া’, ‘তওবা তওবা রে’, ‘আও নারান’, ‘তেরে দিওয়ানি’সহ বেশ কিছু গান দিয়ে উৎসবের দ্বিতীয় রাতের কৃতিত্ব যেন নিয়ে নিলেন ভারতের জনপ্রিয় শিল্পী কৈলাস খের। বাংলায় ঢাকাবাসীকে জানিয়েছেন ভালোবাসা। আর ইংরেজিতে আকুতি জানিয়েছেন আয়োজকদের, এত ভালো শ্রোতাদের সামনে বেঁধে দেওয়া সময়ে গান করা যাবে না। পরেরবার যেন তাঁকে সময় বেঁধে দেওয়া না হয়।

দুই বোনের শেষ রাত
ভারতের নূরান সিস্টার্স—সুলতানা ও জ্যোতি নূরান মুগ্ধ করেছেন এবারও। গত বছরের উৎসবেও তাঁরা শ্রোতাদের প্রিয় শিল্পীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিলেন। আট মাসের শিশুকে নিয়ে এবারে ঢাকায় এসেছিলেন ওস্তাদ গুলশান মীরের এই দুই মেয়ে। গানের শুরুতেই ‘আল্লাহু’ রবে স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে তুলেছিলেন তাঁরা। গেয়ে শুনিয়েছেন ‘দামা দম মাস্ত কালান্দার’ ও ‘পার্দে মে রেহেনে দো’সহ শ্রোতানন্দিত বেশ কিছু গান।

যাঁদের গান প্রশংসিত হয়েছে
আবদুর রহমান বাউল গান শুরু করার পর থেকেই শ্রোতারা চাঙা হয়ে উঠতে শুরু করেন। তবে উৎসবের প্রথম সন্ধ্যায় আসন থেকে শ্রোতাদের টেনে তুলেছিল ভারতের রাজু দাম বাউলের কণ্ঠ। বাংলাদেশের ফরিদা ইয়াসমিনকে নিয়ে যুক্তরাজ্যের সাইমনের দল ‘স্বরা–কান্তি’ বেশ করেছে। ওই রাতেই পাকিস্তানি শিল্পী জাভেদ বশিরের কণ্ঠে ‘দামাদাম মাস্ত কালান্দার’সহ আরও কয়েকটি গানে উল্লসিত হতে দেখা গেছে দর্শকদের।
দ্বিতীয় রাতে বহু দর্শক এসেছিলেন কৈলাস খেরের টানে। শুরুতেই সেই শ্রোতারা বিস্মিত হন বাংলাদেশের জালালের বাঁশির সুরে। লতিফ সরকারের গানেও হৃদয় মজেছে শ্রোতাদের। হঠাৎ মঞ্চে এসে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে গেয়ে বেড়ানো কিশোর শিল্পী জাহিদ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার গাওয়া জনপ্রিয় ‘মধু হই হই আঁরে বিষ হাওয়াইলা’ গানটিই গেয়ে শোনায় সে। এ ছাড়া ভাওয়াইয়া গান দিয়ে শুরু করা ইন্ডিয়ান ওশান বাদ্য বাজিয়েই দুলিয়েছেন পুরো মাঠ। স্পেনের কারেন লুগো ও রিকার্ডো মোরোর ফ্লেমেনকো নৃত্য নতুন হলেও তা আনন্দ দিয়েছে দর্শকদের। অপেক্ষার ক্লান্তি নিয়ে মাঠের পর্দাগুলোর সামনে বসে কারেনের নৃত্য দেখেছেন বেশির ভাগ দর্শক। শেষ দুই পরিবেশনার মধ্যবর্তী বিলম্বে বিরক্ত হয়েছেন দর্শকেরা।
উৎসবের শেষ রাত ছিল পবনের। কোনো শিল্পী সময় বেশি নিচ্ছেন কেউ বা কম। এ নিয়ে মঞ্চের পেছনের মতো সামনেও উত্তাপ ছড়িয়েছে। যথারীতি বারী সিদ্দিকী তাঁর গানের মাধ্যমে হাহাকার ছড়িয়ে দিয়েছেন ঢাকার শ্রোতাদের ভেতর। তাঁর ‘শুয়া চান পাখি’ যেন তাঁকে জীবদ্দশায় দিয়েছে অমরত্ব। নূরান সিস্টার্সের গানে নেচে ক্লান্ত দর্শক একটু বসে থমকে শুনেছেন তাঁদের প্রিয় পবন দাসের গান। বেশ কয়েকজন দর্শক শ্রোতার সঙ্গে কথা বললে বিচিত্র সব মন্তব্য জানা গেছে অন্য শিল্পীদের ব্যাপারে। সেগুলো ছিল—ভালো, মোটামুটি, বেশ ও...।
দর্শক-শ্রোতার মুখ থেকে পাওয়া
—চড়া দামে খাবার কিনে খেতে হয়েছে, সেও আবার ধাক্কাধাক্কি করে। এমনকি সে খাবারও ফুরিয়ে গেছে। এত কম খাবার এনেছে কেন?
—চায়ের স্টল এত কম কেন?
—এত লোক, অথচ শৌচাগার এত কম?
—বিদেশি শিল্পীদের পরিচিতি মাঠে কোথাও দেওয়া থাকলে ভালো হতো। মুখেও ঠিকমতো বলা হয়নি।
—পার্কিং সুবিধা নেই, এত রাতে বাসায় যাব কীভাবে? তরুণদের সঙ্গে বাসে ঝুলে বয়স্করা যেতে পারেন?
—কাজ শেষ করে গান শুনতে এসেছিলেন অনেকে। ১০টায় প্রবেশপথ বন্ধ করা ঠিক হয়নি।
—কনসার্ট হওয়া উচিত সারা রাত, নয়তো রাত ১০টা পর্যন্ত। না হলে বাসায় ঢুকতে সমস্যা হয়।