যে নির্মাতাকে ব্যর্থতা কখনো ছুঁতে পারেনি
![এহতেশামুর রহমান](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2020%2F01%2F30%2Fe9d292b509dd5bf8520100b52048b174-5e328f2c65522.jpg?auto=format%2Ccompress)
বাংলা চলচ্চিত্রের কিছু খ্যাতিমান নাম প্রায় হারিয়ে গেছে সময়ের ব্যবধানে। তবে তাঁদের কাজগুলো রয়ে গেছে। বিশেষ করে পর্দার আড়াল থেকে কাজ করে যাওয়া মানুষদেরকে আলাদা করে মনে রাখা হয় না। আমরা তেমনই কয়েকজন গুণী নির্মাতার কথা জানব। ধারাবাহিক এই আয়োজনে আজ থাকছে ৬০ ও ৭০ দশকে আলোড়ন তোলা কিছু চলচ্চিত্রের পরিচালক এহতেশামের কথা।
ব্রিটিশ ভারতের ক্যাপ্টেন থেকে নির্মাতা
এহতেশাম ১৯২৬ সালের ১২ অক্টোবর পুরান ঢাকার বংশালে জন্মগ্রহণ করেন। মালিটোলা, নাজিরাবাজার, সূত্রাপুর, লালবাগ, সদরঘাট, রাজার দেউড়ি এলাকায় কেটেছে তাঁর শৈশব। পড়াশোনা শেষ করে এই নির্মাতা যোগ দেন ব্রিটিশ ভারতের সেনাবহরে ক্যাপ্টেন হিসেবে। পাকিস্তানের করাচিতে হয়েছিল তাঁর বদলি। ওই দায়িত্বে থাকার সময়ই ১৯৪৫ সালে পাকিস্তানের নির্মাতা আশিক মল্লিকের বাঘী সিনেমার শুটিং দেখতে যান। তাঁর মনে কৌতূহল জন্মায়, সিনেমার চিত্রধারণ কীভাবে হয়? এই দিয়ে শুরু। এরপর এমন একের পর এক প্রশ্ন করতে করতে নতুন এই শিল্পমাধ্যমে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এহতেশাম। ১৯৪৬ সালে নিজের উদ্যোগে নাটোর, সান্তাহার, লালমনিরহাটে তিনটি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করে ফেলেন। সেসব প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্রের পরিবেশক ও প্রদর্শক হিসেবে এহতেশাম উর্দু ছবি দেখানো শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে বিএ খানের অর্থলগ্নিতে চলচ্চিত্র নির্মাণেও আগ্রহী হন। প্রথম চলচ্চিত্র বানাতে গিয়ে বুঝতে পারেন এহতেশাম এতদিন চলে এসেছেন নিজের জগতে।
![দিলীপ কুমারের কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন এহতেশামুর রহমান (ডানে)](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2020%2F01%2F30%2Ff61a3044008a959405a685d6c38b71e9-5e328f2c65e79.jpg?auto=format%2Ccompress)
শুরু থেকেই সফল
প্রথম চলচ্চিত্র এদেশ তোমার আমার ১৯৫৯ সালে মুক্তির পরপরই ব্যবসায়িক সফলতা পায়। পরের বছর নির্মাণ করেন রাজধানীর বুকে। এ ছবির মধ্য দিয়ে এহতেশামের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ছবির ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’ গানটি সবার মুখে মুখে উঠে আসে। এরপর পরিচালক এহতেশামের নাম শুনলেই দর্শকেরা ছবি দেখার জন্য সিনেমা হলে ভিড় করতেন। উর্দুতে এদেশের শিল্পীদের নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন চান্দা (১৯৬২) ও চকোরী (১৯৬৭)। তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দুই জায়গাতেই বিপুল জনপ্রিয়তা পায় ছবি দুটি। ঈদে মুক্তি পেয়ে টানা প্রায় দেড় বছর হলে চলে চকোরী। সে সময় পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় একজন চিত্রসমালোচনায় লিখেছিলেন, সিনেমা বানানো শিখতে হলে সিনেমার তীর্থস্থান ঢাকায় যাও।
তারকা তৈরির কারিগর
গত শতকের ’৫০, ’৬০ ও ’৭০–এর দশকে এহতেশামের ছবিতে অভিনয় করে খ্যাতি পেয়েছেন অনেক অভিনয়শিল্পী, গায়ক ও চিত্রগ্রাহক। এহতেশামের হাত ধরেই অভিনয়ে আসেন শবনম, রহমান, আজিম, শাবানা, নাঈম, শাবনাজ, শাবনূরের মতো তারকারা। উর্দু ভাষায় নির্মিত চকোরী ছবি দিয়ে নাদিম বেগকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এহতেশাম। পরে পাকিস্তানে তুমুল জনপ্রিয়তা পান অভিনেতা নাদিম বেগ। পরে এহতেশামের মেয়ে ফারজানাকে বিয়ে করেন নাদিম বেগ। এ ছাড়া গোলাম মুস্তাফা, খান জয়নুল, রানী সরকার, সুমিতা দেবী, সাদেক বাচ্চুও তাঁর ছবি দিয়েই খ্যাতি পান। এহতেশামের ছবিতেই প্রথম নারী সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন ফেরদৌসী রহমান। নব্বইয়ের দশকে যখন বাংলা সিনেমা গৎবাঁধা ধারায় আবদ্ধ তখন নতুন অভিনেতা–অভিনেত্রী নিয়ে চাঁদনী ছবি তৈরি করেন এহতেশাম। নাইম–শাবনাজ অভিনীত চাঁদনী দারুণ সাফল্য পায়। এর ফলে নতুন অভিনেতা–অভিনেত্রীদের নিয়ে সিনেমা বানানোর সাহস বেড়ে যায় ঢালিউড নির্মাতাদের। মৌসুমী, সালমান শাহ, শাকিল খান, ওমর সানীদের মতো নতুন শিল্পীদের ওপর লগ্নির সাহস তৈরি করে দেন এই নির্মাতা।
![শাবানা ও এহতেশামুর রহমান](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2020%2F01%2F30%2F925707f789f5a58dd3344969cff24aa5-5e328f2c4748f.jpg?auto=format%2Ccompress)
শবনম, শাবানা, শাবনূরের নামের পেছনের গল্প
এহতেশামের হাত ধরে সিনেমায় আসা বেশির ভাগ অভিনেত্রীর নাম ‘শাব’ দিয়ে শুরু। শবনম, শাবানা, শাবনূর, শাবনাজ—এসব নামই এহতেশামের দেওয়া। শাব একটি উর্দু শব্দ, এর অর্থ রাতের আলো। অন্ধকারের মধ্যে আলো কিছুটা রহস্য তৈরি করে। এ জন্যই নির্মাতার শাব শব্দটি ছিল খুব প্রিয়। আর তাই তো আফরোজা সুলতানা রত্না সিনেমায় নাম লিখিয়ে হয়ে যান শাবানা। ঝর্ণা বসাক নাম বদলে হয়ে যান শবনম। একইভাবে পারিবারিক নাম বদলাতে হয়েছে শাবনাজ, শাবনূরকেও।
পরিবারের চোখে এহতেশাম
এই চলচ্চিত্রগুরুকে নিয়মিতই স্মরণ করেন তাঁর কাছের মানুষেরা। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এহতেশামকে এখন আর সেভাবে মনে করা হয় না। এহতেশামের একমাত্র ছেলে মুস্তাকুর রহমান বলেন, ‘বাবা শুধু এটাই চেয়েছেন বাংলাদেশের সিনেমার আগ্রগতি হোক। বোম্বে–পাকিস্তানের অনেক লোভনীয় প্রস্তাব বাবাকে টানেনি। এত বড় মাপের একজন পরিচালক হলেও বাবার মধ্যে অহংকার ছিল না।’ পুত্রবধূ রাফাত রহমান বলেন, ‘আমার শ্বশুরের হাতে গড়া তারকা ও নির্মাতারা এখনো তাঁকে স্মরণ করেন। শাবানা, শাবনূর, নাঈম, শাবনাজ এখনো ফোন দিয়ে আমাদের খবর নেন। যাঁরা তাঁকে চিনতেন তাঁরাই মূল্যয়ন করছেন। কিন্তু চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কোনো সংগঠন থেকে তাঁকে সেভাবে স্মরণ করা হয় কি না, আমাদের জানা নেই।’
![সাবিনা ইয়াসমীন ও এহতেশামুর রহমান](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2020%2F01%2F30%2F5d6e4ef2e163a9f9fed0810b7e68e427-5e328f2c881e3.jpg?auto=format%2Ccompress)
তারকাদের ‘দাদু’
নব্বইয়ের দশকের তারকারা ছিলেন নির্মাতা এহতেশামের কাছে নিজের পরিবারের সন্তানের মতো। নতুন অভিনয়শিল্পীদের তিনি নিজেই বলে দিতেন তাঁকে ‘দাদু’ বলে ডাকতে। নাঈম–শাবনাজ থেকে শুরু করে পরের প্রজন্মের সবাই এই নির্মাতাকে দাদু বলেই জানতেন। নাঈম বলেন, ‘দাদু ছিলেন আমার খুব কাছের একজন। দাদুর মধ্যে আমি ভালো একজন মানুষকে খুঁজে পাই।’ শুটিং সেট আর সেটের বাইরেও এহতেশামকে ‘দাদু দাদু’ বলে অস্থির করে ফেলতেন অভিনেত্রী শাবনূর। যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে হাজির হতেন দাদুর কাছে। শাবনূর বলেন, ‘শুরুর দিকে আমি রোগাপাতলা ছিলাম। আমাকে নিয়ে ছবি বানালে ওই ছবি নাকি চলবে না, সে জন্য অনেকেই চাইছিলেন না দাদু আমাকে তাঁর ছবিতে নায়িকা হিসেবে নিক। কিন্তু আমার ওপর দাদু আস্থা রেখেছিলেন। সেই থেকেই দাদু আমার অভিভাবক।’
বিখ্যাত সিনেমা
এদেশ তোমার আমার, রাজধানীর বুকে, চকোরী, চান্দা, নতুন সুর, চাঁদ ও চাঁদনী, দূরদেশ, পিচ ঢালা পথ, চাঁদনী আর শেষ ছবি পরদেশী—মোট ১০টি ছবি নির্মাণ করেছেন এহতেশাম। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান মিলে দূরদেশ ছবিটি তৈরি করে এক নতুন নজির স্থাপন করেছিলেন এই নির্মাতা। তিন ভাষায় মুক্তি পায় ছবিটি। এতে অভিনয় করেন শশী কাপুর, নাদিম বেগ, শর্মিলা ঠাকুর, ববিতা, রাজ বাব্বর প্রমুখ।
চেয়েছিলেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া করতে
এহতেশামের শেষ ইচ্ছা ছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া নামের একটি সিনেমা করবেন। পাণ্ডুলিপি লেখাও শেষ হয়েছিল। ২০০২ সালে প্রায় সবকিছুই গুছিয়ে এনেছিলেন। বয়স হয়ে যাওয়ায় দ্রুত ছবি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ২০০২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে নিজের স্বপ্ন অসম্পূর্ণ রেখেই এহতেশাম চলে যান না ফেরার দেশে।