স্বপ্ন যদি সত্যি হতো!

কাজপাগল হুমায়ূন আহমেদ
কাজপাগল হুমায়ূন আহমেদ

চেম্বার থেকে বাসায় ফিরছি। আমার গাড়ি যখন এয়ারপোর্ট রোডে, তখন ফোন পেলাম, আমার হুমায়ূন স্যার সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরেছেন। দেশে ফিরবেন জানি, কিন্তু এভাবে ফিরবেন স্বপ্নেও ভাবিনি। স্যারের কোলন ক্যানসার ধরা পড়েছে। ভয়াবহ ক্যানসার সঙ্গে নিয়ে স্যার দেশে ফিরেছেন। 
এত বছর বয়সে আমি ঘুমহীন রাত কাটাইনি কখনো। যত দুঃখ, যত আনন্দ, যত উত্তেজনা আমার জীবনে এসেছিল, কোনো কিছুই আমার ঘুম কেড়ে নিতে পারেনি। কিন্তু সেই রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি।
ভোরবেলা স্যারের বাসায় গেলাম। সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গেলাম আমার বন্ধুদের কাছে, শিক্ষকদের কাছে, যাঁরা আধুনিক ক্যানসার চিকিৎসা সম্পর্কে কাজ করছেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রোগনির্ণয়ের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করলাম। উদ্দেশ্য একটাই—স্যার বাঁচবেন, সেই পথ খুঁজে পাওয়া। কেউ আশা দিল, কেউ দিল না। সকাল থেকে সন্ধ্যা হলো কীভাবে টের পাইনি।
সারা দিন পর সেদিন সন্ধ্যায় স্যারের সামনে বসলাম। তাঁর কথা শুনছিলাম। তাঁর রোগ ও চিকিৎসা নিয়ে। স্যার কথা বলছিলেন তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে। কখনো আশাবাদী হচ্ছিলেন, কখনো নিরাশ। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল—স্যার সুস্থ হবেনই। মনে হচ্ছিল স্যারের একটি কথা, ‘ইম্পসিবল ইজ নাথিং’। আমরা কোনো কাজে আটকে গেলে স্যার এই কথাটি বলতেন। আমার শ্রাবণ মেঘের দিন-এর জেনারেটর নেওয়ার কথা মনে হচ্ছিল বারবার।
শ্রাবণ মেঘের দিন ছবির শুটিংয়ের প্রথম দিনে শ্রাবণের ধারা ঝরছিল অঝোরে। রাস্তাঘাট কাদায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় শুটিংয়ের জন্য বিশাল এক জেনারেটর নিতে হবে দূরের এক বাড়িতে। কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে, ট্রাকে করে অত বড় জেনারেটর নেওয়া, মনে হচ্ছিল একেবারে অসম্ভব। স্যারকে বিষয়টি জানালাম। প্রচণ্ড বকা দিলেন স্যার আমাকে। ধমক দিয়ে বললেন, ‘ইম্পসিবল ইজ নাথিং’। স্যারের ধমক আমার বুদ্ধি খুলে দিল। চিন্তা করে উপায় বের করলাম, কর্দমাক্ত রাস্তায় মহিষের গাড়িই একমাত্র বাহন। আনা হলো মহিষের গাড়ি। শক্তিশালী এক জোড়া মহিষ। সঙ্গে আমরা প্রায় ১০ জোড়া মানুষ। প্রাণান্ত চেষ্টায় জেনারেটর পৌঁছাল শুটিংয়ের বাড়িতে। পসিবল ইম্পসিবল। স্যারের কথা সত্য।
কোথাও ভালো লাগে না আমার। না বাসায়, না চেম্বারে, না শুটিংয়ে। স্যারের বাসায় বসে থাকি। সকাল থেকে রাত্রি। স্যার মাঝেমধ্যে এসে ড্রয়িংরুমে বসেন। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। আমি বসে তাঁর কথা শুনি। তাকিয়ে থাকি তাঁর দিকে। যদি এবার তাঁর কথা সত্যি না হয়—‘ইম্পসিবল ইজ নাথিং’। যদি তাঁকে আর দেখতে না পাই। যদি তাঁর কথা আর শুনতে না পাই। প্রাণভরে তাঁর কথা শুনে নিই, চোখ ভরে তাঁকে দেখে নিই।
স্যারের চিকিৎসা হবে নিউইয়র্কে বিশ্বসেরা ক্যানসার হাসপাতালে। ভোরে ফ্লাইট। সন্ধ্যা থেকেই স্যার গল্পের আসরে বসেছেন। স্যারের গল্প শুনে বোঝার উপায় নেই, শরীরে তাঁর ক্যানসার বাসা বেঁধেছে। ঘরের কোনায় বসে তাঁর কথা শুনছি। একবার অত্যন্ত শক্ত বিশ্বাস ভরা কণ্ঠে স্যার বললেন, ‘তোমরা নিশ্চিত থাকো, আমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবই।’ স্যারের কথা শুনে সব সময় সব কাজে অনুপ্রাণিত হয়েছি। এ কথা শোনার পর আমার আশা শতভাগ পূর্ণ হয়ে গেল। স্যার সুস্থ হয়ে যাবেন।
সে রকমই হতে লাগল। স্যার কেমোথেরাপি শেষ করে দেশে এলেন। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা নুহাশ পল্লী। ভোরবেলা তাঁকে দেখতে গেলাম। বাংলোয় বসে নাশতা করছেন তিনি। আমাকে দেখে বললেন, ‘ডাক্তার, নাশতা করো।’ আমি অবাক! নির্বাক দৃষ্টিতে স্যারের দিকে তাকিয়ে। শতভাগ সুস্থ একজন মানুষের মতো কথা বলছেন তিনি, হাসছেন। রাগছেন। চলাফেরা করছেন। কে বলবে ওনার ক্যানসার? কে বলবে উনি এতগুলো কেমো নিয়েছেন? নাশতা শেষ করে স্যার পুকুরপাড়ে গেলেন। তখন আমি ও খালাম্মা (শ্রদ্ধেয় স্যারের মা) ঘরে বসা। খালাম্মা আমাকে বললেন, ‘কী মনে হয় তোমার, ও ভালো হবে?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘খালাম্মা, এতগুলো কেমো নেওয়ার পর, আক্রান্ত হওয়ার এত দিন পর যিনি এত স্বাভাবিক, ওনার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ।’
স্যার আবার চলে গেলেন নিউইয়র্কে। শতভাগ সফল অপারেশন হলো তাঁর। প্রতিদিন খবর নিই স্যার কেমন আছেন। মাঝেমধ্যে মহানন্দে ভাসি, যখন খবর পাই স্যার ভালো। আবার অস্থির হয়ে উঠি, যখন শুনি স্যারের সমস্যা হচ্ছে। এক এক করে বেশ কয়েক দিন পার হয়ে গেল। তারপর? আমার তৃতীয় চক্ষুকে অন্ধ মনে হলো। সমস্ত হিসাব-নিকাশ ভুল হয়ে গেল। জ্যোৎস্নাময় রাতের স্বপ্ন অমাবস্যার অন্ধকারে হারাল। স্যার চলে গেলেন। আহা রে!
কিছুদিন পর, ভোরের স্বপ্নে দেখি—স্যার সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন। কী সুন্দর চেহারা! রাজপুত্রের মতো। অনেক মানুষের ভিড়। সবাই তাঁকে দেখতে এসেছেন। আমি দূরে দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখছি। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল আমার দিকে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘এই ডাক্তার, তোমার কথাই তো সত্যি হয়েছে, আমি সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছি।’
আহা রে! আমার স্বপ্ন যদি সত্যি হতো।
 অভিনয়শিল্পী