
তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক আনোয়ার হোসেন পিন্টুর প্রথম চলচ্চিত্র। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দিয়েই নির্মাতা হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হলো। ইতিমধ্যে পিন্টু সত্যজিৎ গবেষক ও সংগ্রাহক হিসেবে উভয় বাংলায় পরিচিতি পেয়েছেন। সত্যজিৎ প্রসঙ্গে যেকোনো জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে বা সন্ধানের প্রতিকারে সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। ১৯৯৩ সাল থেকে তাঁর সত্যজিৎ চর্চা কেন্দ্র এ কাজে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করছে। তাঁর সম্পাদিত প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার সংকলন ‘সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ’ দুই বাংলাতেই একটি আকরগ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে এবং ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘সত্যজিৎ-চর্চা’ ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে।
প্রকাশনাগুলোই প্রমাণ করে দেবে যে প্রস্তুতি ও নির্মাণে পিন্টু কতটা আপসহীন ও যত্নবান। কিছুটা আলস্য আর অনেকটাই খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারণে গুরু সত্যজিতের পথ ধরে কাজের কাজ ছবি বানানোটা এতকাল হয়নি। হিমশৈলের নগণ্য ভাসমান শিখরের নিচে তার বিশাল বপু থাকে জলের অতলে লুকিয়ে আর পিন্টুর ভাবনার ফল ধরে বিরল পুষ্প বা বহুবর্ষী ফলের মতো—বহুকালের ব্যবধানে। বলা বাহুল্য, প্রকাশনা দুটো তাঁর কাছে প্রত্যাশা বাড়িয়েছে, কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণে আপাতত পিন্টুর তেমন গরজ নেই।
প্রায় ৬০ ছুঁই ছুঁই বয়সে নির্মিত প্রথম ছবিটির দৈর্ঘ্য মাত্র ২০ মিনিট হওয়ায় একটু আফসোস হয় বৈকি। যে গল্প এ ছবির ভিত্তি, সেটি তুখোড় গাল্পিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী লিখেছেন স্রেফ ১১টি বাক্যে, যার শেষটি এক বর্ণের, দ্বিতীয়টি দুই শব্দের।
তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক সত্যিই আনোয়ার হোসেন পিন্টুর কাছে প্রত্যাশা বাড়িয়েছে। ছবিটি আগাগোড়া ক্যামেরার ভাষাতেই রচিত। প্রথম প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত ভাঁজপত্রে নির্মাতার কথায় পিন্টু লিখেছেন, ‘অপ্রিয় হলেও সত্য, প্রায় ৪০ বছর চলচ্চিত্র নিয়ে সাধন-ভজন করে যা শিখতে পারিনি, তা বুঝতে শিখেছি চিত্রগ্রহণ আর সম্পাদনার টেবিলে এক মাসে।’ এ উপলব্ধি তাঁর নিজের জন্য অপ্রিয় হলেও শিল্পের জন্য এ তো চিরায়ত সত্য। হাতে-কলমে কাজে না নামলে শিল্পের ভেতর-বাইরের রূপ-রস আস্বাদন ও উপলব্ধির সুযোগ ঘটে না। সেদিক থেকে তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক পিন্টুর জন্য চলচ্চিত্রের সদর পথ খুলে দিয়েছে।
তৃতীয় বিশ্বের অস্তিত্ব আজ আর স্বীকৃত নয়। গল্পকার স্বপ্নময়ও একালের দস্তুর অনুযায়ী গল্পের নাম দিয়েছেন—উন্নতিশীল দেশগুলোর সমস্যা। তবে তৃতীয় বিশ্ব তকমার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক যে বিশেষত্ব, তা ঘুচবার নয়। তৃতীয় বিশ্ব বললে দারিদ্র্য, দুর্নীতি, অব্যবস্থার এক অস্থিতিশীল চিত্র মনে গেঁথে থাকে। তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে সাফল্য কিংবা সুকৃতির ঝিলিক দেখা দিয়ে মিলিয়ে যাওয়া—এই তো। তবে মোটাদাগে তৃতীয় বিশ্ব যেন ট্র্যাজেডি, মাঝেমধ্যে ট্র্যাজিক হিরোইজমের প্রকাশ ঘটে। স্বপ্নময়ের গল্পের নায়ক হরিদাস, যে পিন্টুর ছবিতে আলী, সে আস্তাকুঁড়েই থাকে এবং খুঁটে খায়। তার জীবনে রূপকথার মতো কিছু যদি ঘটে, তার পরিণতি হবে ট্র্যাজিক—এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই সম্ভাবনাগুলো অলীক, জাদুবাস্তবতার মতোই।
ছবিতে আলীর ভূমিকায় অলক ঘোষ চমৎকার মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। তাঁর অভিনয়—হাঁটা-চলা-কথা—সব চরিত্রের সঙ্গে বেশ মানানসই ছিল। মৃত্তিকা ও অন্যদের নির্বাচনও চরিত্রানুগ। সম্ভবত যেকোনো শিল্প দুভাবে রসিকজনের মনে নাড়া দিয়ে থাকে—প্রথম ধারাটি নিয়ে পিন্টুর ভাষ্যের সঙ্গে সহমত হব—‘শিল্পের স্ব স্ব ভাষায় দর্শক পাঠক ও শ্রোতার মনে আঁচড় কাটা এবং প্রাণে মোচড় দেওয়াই হলো শিল্পের প্রথম শর্ত।’ দ্বিতীয় ধারাটি একটু বিস্তারের মাধ্যমে ধীরে ধীরে অনুপুঙ্খে সমঝদারের মনে গভীরভাবে দাগ কাটতে থাকে। সবখানেই ডিটেল বা অনুপুঙ্খের গুরুত্ব আছে, তবে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে তা ঘটবে চমকের মতো একটি-দুটি সিচুয়েশন বা শটের মাধ্যমে।
পিন্টু তেমনটা করার চেষ্টা করেছেন, তবে তাঁর হাতের নানা অস্ত্র, যেমন আবহ সংগীত, নগরী-দৃশ্য (cityscape) বা মূল চরিত্রের কোনো বিশেষত্ব ফুটিয়ে এক লহমায় অনেক কথা বলে দেওয়ার, অর্থাৎ ছোট্ট বীজ-দৃশ্য, বীজ-সংগীত, বীজ-অভিব্যক্তি আকাশসমান হয়ে শ্রোতা-দর্শককে গ্রাস করে নেবে। নির্মাতার এই গুণ পিন্টুর আছে, কিন্তু তাঁকে বাগিয়ে কাজে লাগানোর জন্য যেন আরেকটু সাহস—স্রষ্টার সাহসের প্রয়োগ দরকার ছিল। আর তাহলে গল্পের শেষ মোচড়টাকেও ঠিকঠাকভাবে চলচ্চিত্রে ফোটানো যেত। তবে আবারও বলব, পিন্টু তাঁর অনেক দিনের জাড্য ভেঙে জঙ্গম হয়ে উঠছেন অবশেষে—এই ঘটনাই আমাদের আনন্দিত করে তুলেছে, আর তাঁর প্রথম ছবির ২০ মিনিটের ঔজ্জ্বল্য করছে আশাবাদী।