'আমি এখন শুধুই শ্রোতা, আপনার গান শুনব'

জীবনের জলসাঘর থেকে বিদায় নিলেন মান্না দে। বাংলা গানকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য উচ্চতায়। ভারতীয় সংগীতজগতের শীর্ষছোঁয়া এই কিংবদন্তি শিল্পীর প্রতি ‘আনন্দ’-এর শ্রদ্ধা

মান্না দে [জন্ম: ১ মে ১৯১৯—মৃত্যু: ২৪ অক্টোবর ২০১৩]
মান্না দে [জন্ম: ১ মে ১৯১৯—মৃত্যু: ২৪ অক্টোবর ২০১৩]

মান্না দেও চলে গেলেন। কী মাপের শিল্পী ছিলেন তিনি, আজ সেটি নতুন করে না বললেও চলে। কারও সঙ্গেই তাঁর তুলনা করা যাবে না। গলার মেলোডিটা একদম অন্য রকম। কী বলব, তাঁর একেকটা গান একেক ধরনের—কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। তাই মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়েছে, মান্না দের ভেতর হয়তো অলৌকিক কোনো ক্ষমতা ছিল।
আমার স্মৃতিতে মান্না দে আছেন এক ভিন্ন মাত্রায়। কেন বললাম কথাটি? কারণ, আমি তো তাঁকে আজকে থেকে চিনি না; চিনি সেই তখন থেকে—যখন তিনি বাংলা গানের বরপুত্র হননি, যখন তাঁর গলায় কেউ শোনেনি বাংলা গান।
১৯৫৫-৬০ সালের দিকে আমি এবং কমল দাশগুপ্ত সংসার পেতেছিলাম কলকাতার বেথুন রোডে। আমাদের বাড়ির খুব কাছেই ছিল মান্না বাবুর চাচা কৃষ্ণচন্দ্র দের বাড়ি। তিনি থাকতেন সেই বাড়িতে—চাচার কাছে থেকেই গান শিখেছেন। ফলে আমি প্রায়ই দূর থেকে দেখতাম তাঁকে। এর মধ্যে একদিন শুনলাম মান্না দের প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড। কী অপূর্ব গায়কিতে তিনি গাইলেন ‘তির ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঘর।’ গানটি শোনার পর কেন যেন আমার ভেতরে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হলো। কমলকে বললাম, রেকর্ডে মান্না দের একটা গান শুনেছি। ওই রেকর্ডটি আমার কিনতে হবে। কমল তৎক্ষণাৎ রেকর্ডটি কিনে আনলেন। এরপর অনেকবার শুনেছি গানটি। শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলেছিলাম, মনে মনে গুনগুনও করতাম; কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, মান্না দের কণ্ঠেই গানটি শুনতে বেশি ভালো লাগত।

ফিরোজা বেগম ও মান্না দে
ফিরোজা বেগম ও মান্না দে

বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে বোধ হয় আমিই প্রথম মান্না দের সঙ্গে একত্রে অনুষ্ঠান করেছি। প্রথম অনুষ্ঠান শিলিগুড়িতে, সম্ভবত ১৯৭৯-৮০-এর দিকে। তারপর কলকাতার রবীন্দ্রসদন, কলামন্দির, নজরুলমঞ্চে আরও কত অনুষ্ঠান! তিন ঘণ্টার প্রতিটি অনুষ্ঠানে অর্ধেক সময় গাইতাম আমি বাকি অর্ধেক মান্না বাবু। এ সময় তাঁর সঙ্গে নানা অন্তরঙ্গ কথাবার্তা ও সৌহার্দ্য হয়েছিল। এত বড় মাপের শিল্পী তিনি, কিন্তু বিনয়ের কমতি ছিল না।

কফি হাউসের আড্ডায়
কফি হাউসের আড্ডায়

একবার কলকাতার দেবদাস চলচ্চিত্রে নজরুলের ‘শাওন রাতে যদি’ গানটি প্লেব্যাক করার জন্য আমাকে অনুরোধ করা হলো। কারণ, এর মধ্যেই আমার গলায় দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল এ গান। তবে শিল্পীজীবনের প্রথম থেকেই আমার পণ, চলচ্চিত্রে গান করব না। তাই দেবদাস ছবিতে ওই গানটি নারী মুখের বদলে পুরুষের মুখে নিয়ে যাওয়া হলো—চুনিলালের মুখে এটি গাইলেন মান্না দে। এ গান নিয়ে সে সময় তিনি অসংখ্যবার কথা বলেছেন আমার সঙ্গে। কখনো বলেছেন, আপনার রেকর্ডটি শুনতে হবে। তারপর গান করব। আবার কখনো তাঁর কথা ছিল, ‘গানটি আপনি করলেই পারতেন। এটা অমর হয়ে থাকত। আপনার গলাটা কিন্তু ফিল্মেরই গলা।’—এ রকম বিনয় আমি খুব কম শিল্পীর মধ্যেই দেখেছি।
আরেকটা ঘটনা বলি। নজরুলমঞ্চে আমার ও মান্না দের দ্বৈত গানের অনুষ্ঠান। আয়োজকদের আমি বললাম, অনুষ্ঠানের প্রথম অংশে আমি গাইতে চাই; আর চাই বিরতির পর দ্বিতীয় অংশে গান করুন মান্না দে। কেননা, তাঁর গান আমিও মনভরে শুনতে চাই। তো, আমার পরিবেশনার শেষে শ্রোতাদের আমি বললাম, এখন গান করবেন মান্না দে। ওমা, মুহূর্তেই শুরু হলো শোরগোল—সবাই আমাকে বলছে, আপনার কণ্ঠে ‘শাওন রাতে যদি’ শুনতে চাই। কিন্তু আমি তো তখন মান্না বাবুর গান শোনার জন্য অধীর। বললাম, এ গানটি আজ মান্না বাবুর গলায়ই শুনব। শ্রোতারা তবুও নারাজ। এর মধ্যে দেখি মঞ্চে উঠে এসেছেন মান্না দে। ‘“শাওন রাতে যদি” আজ আপনিই করুন’—আমার উদ্দেশে তাঁর এক টুকরো কথা।

স্ত্রী সুলোচনা কুমারনের সঙ্গে
স্ত্রী সুলোচনা কুমারনের সঙ্গে


বললাম, আমি এখন শুধুই শ্রোতা, আপনার গান শুনব। অবশেষে আমার অনুরোধে সেদিন ‘শাওন রাতে যদি’ গেয়েছিলেন তিনি।
তাঁর সঙ্গে আমার স্মৃতি তো অনিঃশেষ—একটার পর আরেকটা মনে পড়ে। মনে পড়ে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিল্পকলা একাডেমীর পক্ষ থেকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও মান্না দেকে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ সময় শিল্পীদের আনার ক্ষেত্রে আমার ভূমিকা ছিল মধ্যস্থতাকারীর। পরে অবশ্য মান্না বাবু অনেকবার বাংলাদেশে এসেছেন, তাঁর অপূর্ব গায়কিতে মুগ্ধ করেছেন আমাদের।
মান্না দে ও আমি একই ঘরানার। তাঁর চাচা কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে সরগম শিখেছেন কমল। আর কমলের কাছে আমি। এই সূত্রে আমাদের মধ্যে অদৃশ্য এক রাখিবন্ধন তো আছেই। তাঁর গান আজও তন্ময় হয়ে শুনি। জানি না, আমার এ কথাগুলো আকাশের ওপার থেকে মান্না বাবু শুনতে পাবেন কি না, তবুও তাঁকে এখন বলতে ইচ্ছা করছে, ‘মান্না বাবু, আমি এখন শুধুই শ্রোতা, আপনার গান শুনব।’
অনুলিখন: আলতাফ শাহনেওয়াজ