'ভালো তো ভালো না!'

মুকিত জাকারিয়ার স্বপ্নের নায়িকা ববিতা। চট্টগ্রামে মুসলিম হাইস্কুলে পড়ার সময় স্কুল ফাঁকি দিয়ে বারবার ছুটে যেতেন স্বপ্নের নায়িকার কাছে। তাঁদের বাড়ির পাশেই ছিল সিনেমা হল। তবে সে সময় কখনো ভাবেননি, একদিন তিনি নিজেও হয়ে যাবেন তারকা—‘মডেল’ ও ‘অভিনেতা’। বড় হয়েছেন বন্ধুদের তিরস্কার পেতে পেতে। ‘আসলে আমার বন্ধুরা ছিল একটু অন্য রকম। আমি কোনো কিছু বললে বা করলেই তাঁরা অপমান করত। এমনকি আমার পোশাক নিয়েও কটাক্ষ করতে ছাড়ত না। কিশোর বয়সে ব্যাপারটা খুব কষ্ট দিত আমাকে।’ সরল স্বীকারোক্তি মুকিত জাকারিয়ার। তিনি জানান, এখন অবশ্য দিন বদলেছে। তাঁরা ঠিক উল্টো আচরণ করেন।
শুধু মুকিতের বন্ধুরা নন, একটি মুঠোফোনের কয়েকটি বিজ্ঞাপনে কাজ করার কারণে এখন যেখানেই যান, সেখানেই মানুষজনের উচ্ছ্বাস তাঁকে ঘিরে। ‘আরে, উনারে তো টিভিতে দেহি। উনি তো মিসকল মফিজ। উনিই তো চায়ের দামে শরবত খান।’ বাংলালিংকের বিজ্ঞাপনে তাঁর সংলাপ ‘ভালো তো, ভালো না!’—এখন ব্যাপক জনপ্রিয়। কীভাবে এলেন তিনি এই মডেলিং-অভিনয়ের ভুবনে? মুকিতের উত্তর, ‘গালি খাওয়ার মাধ্যমে।’
উত্তর শুনে আমাদের চক্ষু যখন ছানাবড়া, তখন বিষয়টি তিনি নিজেই খোলাসা করলেন, ‘একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করার সুবাদে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। তিনি প্রায়ই আমাদের অফিসে আসতেন। একদিন আমার কাছে পাঠালেন ছবিয়ালের শরাফ আহমেদ জীবনকে। জীবন এসেই আমাকে গালি দেওয়া শুরু করলেন—অকথ্য সব গালি। আমি তো অবাক, বুঝতে পারছি না আমাকে গালি দেওয়া হচ্ছে কেন! আমার সহকর্মী জীবনকে থামানোর চেষ্টা করলেন। তাতে গালির মাত্রা আরও বেড়ে গেল! অগত্যা আমি চুপচাপ গালি শুনতে থাকলাম।
‘অবশেষে একসময় থামল জীবনের গালাগাল। এবার দেখি, তিনি সোজা আমার হাত চেপে ধরেছেন! বললেন, “ভাই, আমাকে মাফ করে দেন। আমাকে এভাবেই বলে দিয়েছেন ফারুকী ভাই। আপনাকে এখনই আমার সঙ্গে যেতে হবে। শাড়ি নাটকের জন্য তিনি এমন একজন অভিনেতা খুঁজছেন, যিনি অনেক গালি খেয়েও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারবেন। ফারুকী ভাই মনে মনে আপনাকেই নির্বাচন করেছেন। এতক্ষণ আপনার পরীক্ষা হলো মাত্র।”’ মুকিত বলছেন আজ থেকে তিন-চার বছর আগে ঘটে যাওয়া তাঁর জীবনের গল্প, বিনোদন জগতে পা রাখার কাহিনি।
এর পরের গল্প না বললেও চলে—টেলিভিশনের পর্দায় মুকিতকে সবাই দেখেছেন। তবে এত দূর আসার জন্য মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি বলেন, ‘ফারুকী আগের মুকিতকে ভেঙে ফেলেছেন—আমার ভেতর থেকে সবকিছু বের করে নিয়েছেন। একইভাবে আজকের এই আমার ভেতরে সবকিছু আবার তিনিই ঢুকিয়ে দিয়েছেন।’
শুরুটা নাটক দিয়ে হলেও এর মধ্যে ৩৮টি বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করেছেন মুকিত। এর বেশির ভাগই বাংলালিংকের। অভিনয় করেছেন শ খানেক নাটকে। পা বাড়িয়েছেন সিনেমায়ও। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত টেলিভিশন চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় মনে রাখার মতো। চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া এই অভিনয়শিল্পী বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ঘুরেছেন দেশের অনেক জায়গাতেই। বড় হয়েছেন অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, ‘এমন হয়েছে, একটা রাবারের স্যান্ডেল পরে দিনের পর দিন স্কুলে গিয়েছি, এ জন্য হাসাহাসি করেছে বন্ধুবান্ধব।’ এভাবে বেড়ে উঠতে উঠতে একসময় চট্টগ্রামে ব্যান্ড দল গঠন করেছিলেন মুকিত। হয়েছিলেন চামবার (চট্টগ্রাম মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন) সভাপতি। সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় নিয়মিত কনসার্টের আয়োজন করতেন তিনি। সেই সুবাদে একসময় তাঁর চাকরি হয় স্বনামধন্য একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। এখন নিজেই একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার অন্যতম স্বত্বাধিকারী। পাশাপাশি চুটিয়ে অভিনয় করছেন। স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান টুসিকে নিয়ে সুখের জীবন তাঁর। তাঁর কাছে আমাদের শেষ প্রশ্ন ছিল, নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে এসেছেন আপনি। এ জীবনটি আসলে কেমন? ‘ভালো তো, ভালো না!’—হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন মুকিত জাকারিয়া।