'মোরে বাঁচাইতে এত মানু আইছে!'

স্বপ্ন পথিক নাটকের দৃশ্য
স্বপ্ন পথিক নাটকের দৃশ্য

মানুষের হাত দিগন্তপ্রসারিত হয় তখনই, যখন মানুষেরই সাহায্যে তা বাড়িয়ে দিতে হয়৷ তাই স্বপ্ন পথিক নাটকের শেষ দৃশ্যে মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে নিরাপত্তাপ্রহরী আজিজুল হাকিমের কণ্ঠ দিয়ে উচ্চারিত হয়, ‘মোরে বাঁচাইতে এত মানু আইছে!’
লিখছি আরণ্যক নাট্যদল প্রযোজনা স্বপ্ন পথিক নিয়ে৷ লিখেছেন সুলেখক হারুন রশীদ, নির্দেশনা দিয়েছেন প্রবাদপ্রতিম নির্দেশক মামুনুর রশীদ৷ রাধা রানী, ফোয়ারা, জরিনা বেগম—যাদের কেউ কেউ একসময় বাসাবাড়িতে কাজ করত৷ নিজেদের নাম ঢাকা পড়েছিল ‘বুয়া’ নামের আড়ালে৷ গার্মেন্টসে চাকরির সুত্রে তারা ফিরে পেয়েছে তাদের নাম৷ বেতন তোলে নিজেদের নাম স্বাক্ষর করে৷ রাধা রানীর স্বপ্ন, একটা টু-ইন-ওয়ানে গান শুনে সে পেটের খিদে ভুলবে৷ জরিনার স্বপ্ন এক যুবক, যে তাকে ভালোবাসার কথা বলেছিল৷ ফোয়ারাসহ সবার চোখেই কড়কড়া ভাতের গন্ধ মেশানো স্বপ্ন৷ ফ্লোর ম্যানেজার জয়নাল আবেদিনের বৈরী ব্যবহারকে উপেক্ষা করেই তারা বুনে চলে স্বপ্নের চাদর৷ আর তখনই শব্দ আর আলোর কারুকাজে কেঁপে উঠল কারখানা ভবন৷ ঘটে গেল রানা প্লাজার অনুরূপ এক ট্র্যাজেডি৷ মঞ্চ পরিণত হলো এক মৃত্যুকূপে৷ জরিনা, রাধা রানী, বেগম, ফোয়ারা, জয়নাল, হাকিমের মৃত্যু দর্শনে সিক্ত হলো দর্শকহৃদয়৷ অন্যদিকে, শ্রমিকদের জীবন বাঁচাতে কিছু মানবিক মানুষের নিজের জীবন বাজি ধরার সাহসও দেখল দর্শক৷ মিডিয়ার উপস্থিতি প্রায় অসহ্য হয়ে উঠলে উদ্ধারকাজে নিয়োজিত অফিসার বলেই ফেলল, প্রেসকে বেশি পাত্তা দেওয়াতেই এমন হয়েছে৷
উদ্ধারকর্মে নিয়োজিত কমান্ডার বলল, এটা দুর্ঘটনা নয়, হত্যা৷
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি তো প্রকৃতই এক পরিকল্পিত হত্যা ছিল৷
অভিনয়ের প্রসঙ্গে আসি৷ তমালিকা কর্মকার তাঁর সু-অভিনয় দিয়ে রাধা রানী চরিত্রটি এমনভাবে তৈরি করেছেন যে একবারও মনে হয়নি মঞ্চে এটি অভিনীত হচ্ছে; বরং মনে হয়েছে, বাস্তবিকই আমি রাধা রানীকে কর্মরত দেখছি কোনো এক পোশাক কারখানায়৷ ফোয়ারা চরিত্রটি করেছেন রুবলী চৌধুরী, তাঁর কণ্ঠ প্রক্ষেপণ অসম্ভব ভালো৷ ফোয়ারাকে তিনি মর্মে অনুভব করে সফল অভিনয় করেছেন৷ মোমেনা চৌধুরী করেছেন জরিনার চরিত্রটি৷ শেষ দৃশ্যে তাঁর গ্রামে ফিরে যাওয়ার আকুতি, তাঁর সেই ভালোবাসার যুবককে স্মরণ করা—সবকিছুর ভেতরেই ছিল বুকের ভেতরে মোচড় দেওয়া আবেদন৷ অত্যন্ত ভালো লেগেছে ভবনমালিক সাজ্জাদ সাজু আর উদ্ধারকর্মী মমিনের চরিত্রাভিনেতা হাশিম মাসুদের অভিনয়৷ একজন নিবেদিত ফায়ার সার্ভিস কমান্ডারের চরিত্রে মামুনুর রশীদকে খুব ভালো লেগেছে৷ একই রকম ভালো লেগেছে উদ্ধারকাজে নিয়োজিত অফিসার হারুন রশীদের অভিনয়ও৷ একজনের অভিনয়ের কথা উল্লেখ না করলে অভিনয়ের শেষ কথা বলা হবে না৷ তিনি ফ্লোর ম্যানেজারের চরিত্রের অভিনেতা রুহুল আমিন৷ কণ্ঠ, অভিব্যক্তি, শরীর ও চলনের ভঙ্গি—সবকিছুকে অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে তিনি খুব ভালো অভিনয় করেছেন৷
ভবনধসের পরে মঞ্চসজ্জা প্রায় বিশ্বাসযোগ্য হলেও ভাঙাচোরা স্ট্রাকচারগুলো একদম পেছনে থাকায় এর ভয়াবহতাটা ফুটেও যেন ফোটেনি৷ তবে ভবনের কলামের ভেতরে লাল কাপড় ঝুলিয়ে মঞ্চপরিকল্পক ফয়েজ জহির যে আবহ তৈরি করেছেন, তার প্রশংসা করতেই হবে৷ আলোকপরিকল্পনায় ঠান্ডু রায়হান অপ্রয়োজনীয় কোনো চমক সৃষ্টির চেষ্টা করেননি বলে ভালো লেগেছে৷ একটি সুলিখিত পাণ্ডুলিপি ছাড়া একটি সুনাটক নির্মাণ অসম্ভব৷ হারুন রশীদের পাণ্ডুলিপির সামর্থ্য নিয়ে মামুনুর রশীদ একটি সফল নাটক নির্মাণ করেছেন৷ স্বপ্ন পথিক নাটকটি রানা প্লাজা ধসের এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে৷ নাটকটি দেখবেন৷