ওসামা বিন লাদেনকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া গেল, কীভাবে হত্যা, উঠে এল তথ্যচিত্রে
বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়। ব্যর্থতা জমে জমে হতাশা পাহাড়সমান হয়। তবু তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির অধিকারী গোয়েন্দা সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছিল।
এই ব্যর্থ প্রচেষ্টার সময়ের ব্যাপ্তি যখন দশক ছুঁই ছুঁই, ঠিক তখনই একটি ‘ক্লু’ পাওয়া যায়। এই সূত্র ধরেই বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর, ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গি নেতার খোঁজ পেয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। তারপর অত্যন্ত গোপন ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান চালিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়।
ওসামা বিন লাদেনের মাথার দাম ২৫ মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় এক দশকের প্রচেষ্টার পর বিস্ময়করভাবে তাঁকে খুঁজে পেয়ে দুঃসাহসী অভিযান চালিয়ে আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা প্রধানকে হত্যা করার বহুল আলোচিত ঘটনার বিস্তারিত উঠে এসেছে নেটফ্লিক্সের নতুন এক তথ্যচিত্রে।
গত মাসে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া তিন পর্বের তথ্যচিত্র ‘আমেরিকান ম্যানহান্ট: ওসামা বিন লাদেন’ যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন ড্যানিয়েল সিভান ও মোর লৌসি। তথ্যচিত্রটির পর্ব তিনটির শিরোনাম যথাক্রমে ‘আ নিউ কাইন্ড অব এনিমি’, ‘গ্লাভস আর অফ’ ও ‘অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার’।
যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও বারাক ওবামা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট এমন সব কর্মকর্তার জবানি এখানে রয়েছে, যা আগে কখনো কোনো তথ্যচিত্রে আসেনি।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা চালায় ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন আল-কায়েদা। সেদিন চারটি উড়োজাহাজ হাইজ্যাক করেছিল আল-কায়েদার জঙ্গিরা। এই ঘটনা দিয়ে তথ্যচিত্রটি শুরু হয়ে এগিয়ে যায়।
নাইন–ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলা
সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের (টুইন টাওয়ার) উত্তর টাওয়ারে ঢুকে পড়ে একটি উড়োজাহাজ। সকাল ৯টা ৩ মিনিটে দক্ষিণ টাওয়ারে আঘাত হানে দ্বিতীয় উড়োজাহাজ। সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে তৃতীয় উড়োজাহাজটি দিয়ে হামলা চালানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনে। আর চতুর্থ উড়োজাহাজটির সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু ছিল মার্কিন ক্যাপিটল ভবন। কিন্তু এই উড়োজাহাজের যাত্রীরা জঙ্গিদের রুখে দিয়েছিলেন। সকাল ১০টা ৩ মিনিটে উড়োজাহাজটি পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে বিধ্বস্ত হয়। নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন প্রায় তিন হাজার মানুষ।
প্রথমে মার্কিন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সন্ত্রাসী হামলার বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেননি। দ্বিতীয় উড়োজাহাজটি বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের দক্ষিণ টাওয়ারে ঢুকে পড়লে তাঁরা বুঝতে পারেন, এটা সন্ত্রাসী হামলা।
ঘটনার সময় প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ছিলেন না। তিনি ছিলেন ফ্লোরিডায়, স্কুলশিশুদের একটি অনুষ্ঠানে। দ্বিতীয় হামলার পর তাঁর কাছে ছুটে যান হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ অ্যান্ড্রু কার্ড। তিনি প্রেসিডেন্টের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেন, ‘আরেকটি উড়োজাহাজ দ্বিতীয় টাওয়ারে আঘাত হেনেছে। আমেরিকা হামলার শিকার।’ বুশ হতবাক-স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে থাকেন।
সেদিন সকালে হোয়াইট হাউসে একটি বেনামি ফোনকল আসে, যাতে বলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্টকে বহনকারী উড়োজাহাজ এয়ারফোর্স ওয়ান পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু। এ খবরে উড়োজাহাজটিতে তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালানো হয়। তবে কিছু পাওয়া যায়নি। সন্ধ্যায় যুদ্ধবিমানের পাহারায় রাজধানীতে ফেরেন বুশ।
শুরুতে সিআইএ নিশ্চিতভাবে জানত না, কে বা কারা এই সন্ত্রাসী হামলার পেছনে রয়েছে। পরে তারা উড়োজাহাজের যাত্রীদের তালিকাসহ অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হয়, এই হামলার পেছনে রয়েছে আল-কায়েদা। বুশকে এই তথ্য জানালে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ঘোষণা দেন, এই সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করে নির্মূল করা হবে।
অপরিচিত ছিলেন না
ওসামা বিন লাদেন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের অপরিচিত কেউ ছিলেন না। সৌদি আরবের একটি ধনী ও প্রভাবশালী পরিবারের এই সদস্য গত শতকের আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়ে মুজাহিদদের পাশে দাঁড়ান। একই সময় যুক্তরাষ্ট্রও আফগান মুজাহিদদের সাহায্য-সমর্থন দিচ্ছিল। তাই তখন ওসামা বিন লাদেনকে ‘মহান যোদ্ধা’ হিসেবে বিবেচনা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয় সোভিয়েতরা। এই জয় ওসামা বিন লাদেনকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করে। তিনি একটি নতুন ইসলামি সাম্রাজ্যের সূচনা করতে চেয়েছিলেন। সেই লক্ষ্যে গঠন করেন আল-কায়েদা। একপর্যায়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে তাঁর লক্ষ্য অর্জনের প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেন।
তালেবান ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। ওসামা বিন লাদেন ও তাঁর আল–কায়েদাকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিল আফগানিস্তানের তৎকালীন তালেবান সরকার।
সিআইএ ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকেই ওসামা বিন লাদেন ও তাঁর কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখছিল। নাইন-ইলেভেনের হামলার পর ওসামা বিন লাদেনকে ওয়াশিংটনের হাতে তুলে দিতে তালেবান সরকারকে বারবার বলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তালেবান সরকার তা করতে অস্বীকৃতি জানালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে।
হত্যার সুযোগ হাতছাড়া
সন্ত্রাসবাদবিরোধী এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে যোগ দেয় আফগানিস্তানের নর্দান অ্যালায়েন্স। অচিরেই কাবুলে তালেবান সরকারের পতন হয়। ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানের পাকিস্তান সীমান্তবর্তী গুহা ও সুড়ঙ্গবহুল তোরা বোরা পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় নেন। এই তথ্য জানার পর তোরা বোরায় ব্যাপক বোমা হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাঁকে ধরতে স্থলসেনা পাঠাতে অনাগ্রহী ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
তোরা বোরা অভিযানের পর সিআইএর কিছু কর্মকর্তা ধারণা করেছিলেন, ওসামা বিন লাদেন হয়তো নিহত হয়েছেন। কিন্তু ছয় মাস পর তাঁর ভিডিও টেলিভিশনে প্রচারিত হলে মার্কিন গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন, তিনি বেঁচে আছেন।
খোদ সিআইএর কর্মকর্তারাই স্বীকার করেন, তোরা বোরায় ওসামা বিন লাদেনকে ধরার বা হত্যার পূর্ণ সুযোগ ছিল, কিন্তু তা ব্যবহার করা হয়নি। ফলে তিনি তোরা বোরা থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
তোরা বোরা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদা দেশে দেশে একের পর এক রক্তক্ষয়ী হামলা চালাতে থাকে। তিনি হত্যার হুমকি দিয়ে মার্কিনদের তটস্থ করে রাখেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে খুঁজে পাচ্ছিল না।
এবার ভিন্ন পথে হাঁটেন মার্কিন গোয়েন্দারা। তাঁরা ওসামা বিন লাদেনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ লোকদের শনাক্ত করতে তৎপর হন। তাঁদের একজন খালিদ শেখ মোহাম্মদ। নাইন-ইলেভেন ও অন্যান্য হামলার মূল পরিকল্পনাকারী খালিদকে কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে বন্দিশিবিরে অকথ্য নির্যাতন করেও ওসামা বিন লাদেন সম্পর্কে কোনো তথ্য বের করতে পারেননি মার্কিন গোয়েন্দারা।
২০০১ সালের পর বিভিন্ন সময় চাউর হয়, ওসামা বিন লাদেন গুরুতর অসুস্থ কিংবা তিনি মারা গেছেন। তবে এসব কথা যে ভুয়া ছিল, তার প্রমাণ ওসামা বিন লাদেন নিজেই দিতেন—বারবার ভিডিও–অডিও বার্তা পাঠিয়ে।
ওসামা বিন লাদেনকে ধরতে না পেয়ে রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়েছিলেন মার্কিন গোয়েন্দারা। তাঁরা নিজ দেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছিলেন। এমনকি তাঁদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
‘ব্রেকথ্রু মোমেন্ট’
২০০৯ সালে বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরই তিনি ওসামা বিন লাদেনকে ধরার তৎপরতা দ্বিগুণ করার নির্দেশ দেন। তিনি সিআইএর পরিচালক লিওন পেনেট্টাকে জানিয়ে দেন, ওসামা বিন লাদেনকে ধরাই হবে তাঁর (পেনেট্টা) কাজের অগ্রাধিকার।
পেনেট্টা একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেন, যেটি শুধু ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পাওয়া নিয়েই কাজ করছিল। তারা বিশেষভাবে মনোযোগ দেয় কুরিয়ার (বাহক) শনাক্তকরণে। ওসামা বিন লাদেনের ভিডিওগুলো কীভাবে সংবাদমাধ্যমে যায়, কে তা পৌঁছে দেয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করতে করতে মার্কিন গোয়েন্দারা আবু আহমেদ নামের এক কুরিয়ারকে শনাক্ত করেন।
২০১০ সালের গ্রীষ্মে মার্কিন গোয়েন্দাদের জন্য একটা ‘ব্রেকথ্রু মোমেন্ট’ আসে। ফোনকল ট্র্যাক করে পাকিস্তানের পেশোয়ারে আবু আহমেদের অবস্থান শনাক্ত হয়। তিনি পেশোয়ার থেকে গাড়িতে করে অ্যাবোটাবাদ গেলে তাঁকে অনুসরণ করেন মার্কিন গোয়েন্দারা। আবু আহমেদ গাড়ি নিয়ে অ্যাবোটাবাদের একটি বাড়ির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন।
সন্দেহজনক বাড়ি
অ্যাবোটাবাদের এই বাড়ি সাধারণ বাড়ির মতো ছিল না। চারপাশের উচ্চ প্রাচীরসহ বাড়িটির অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ছিল অত্যন্ত সন্দেহজনক। মার্কিন গোয়েন্দারা সন্দেহ করেন, বাড়িটিতে বড় মাপের কেউ আছেন। এসব তথ্য দ্রুত ওবামাকে জানানো হয়। তিনি বাড়িটির ব্যাপারে বিস্তারিত তদন্ত ও নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেন।
মার্কিন গোয়েন্দারা বিভিন্ন উপায়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন। বিশেষ করে তাঁরা লক্ষ করেন, বাড়িটি থেকে বাইরে ময়লা-আবর্জনা আসে না, যা অনেকটা অস্বাভাবিক। বাড়িটির বাসিন্দাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য ভুয়া পোলিও টিকাকর্মীদের কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছিলেন মার্কিন গোয়েন্দারা, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়।
মার্কিন গোয়েন্দারা আলামতসহ নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখতে পান, আবু আহমেদ ও তাঁর ভাইয়ের পরিবার ছাড়াও তৃতীয় একটি পরিবার বাড়িটিতে আছে। কিন্তু এই তৃতীয় পরিবারটির সদস্যরা কখনো বাড়ির বাইরে আসেন না।
ওসামার সঙ্গে সাদৃশ্য
স্যাটেলাইট ও নজরদারি ভিডিওতে মার্কিন গোয়েন্দারা দেখতে পান, কিছুটা বয়স্ক এক ব্যক্তি বাড়িটির আঙিনায় নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করছেন। তাঁরা তাঁর ছায়ার দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেন, তা ওসামা বিন লাদেনের উচ্চতার সঙ্গে তুলনা করেন। এ ছাড়া হাঁটার ভঙ্গি, শরীরের গঠনসহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে তাঁরা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে সাদৃশ্য পান।
মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে সরাসরি শতভাগ প্রমাণ ছিল না যে বাড়িটিতে ওসামা বিন লাদেন আছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওবামা একটা বড় ঝুঁকি নেন। তিনি বাড়িটিতে অভিযানের প্রস্তুতি নিতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট স্পেশাল অপারেশনস কমান্ডের অ্যাডমিরাল উইলিয়াম ম্যাকরাভিনকে অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঠিক হয় অভিযান চালাবে বিশেষ বাহিনী নেভি সিলের অত্যন্ত দক্ষ ও গোপনীয় ইউনিট টিম-৬। অভিযানের জন্য সেরা সদস্যদের বাছাই করা হয়। কঠোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অ্যাবোটাবাদের বাড়িটির আদলে কাঠামো গড়ে শতাধিকবার মহড়া চালানো হয়।
‘অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার’
পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের জালালাবাদ ছিল এই অভিযান পরিচালনার প্রধান ঘাঁটি। অ্যাবোটাবাদে পাকিস্তানের মিলিটারি একাডেমিসহ অন্য সামরিক স্থাপনা থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অভিযানটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। ওবামা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, অভিযানের ব্যাপারে পাকিস্তানকে আগাম জানবেন না। কারণ, আল-কায়েদার কাছে অভিযানের তথ্য পাচার হয়ে যেতে পারে।
পাকিস্তানের রাডার–ব্যবস্থা কোথায় আছে, রাডারগুলো কী রকম, সেগুলো কীভাবে ফাঁকি দেওয়া যায়, তা বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্র। অভিযানের জন্য বিশেষ ধরনের নতুন হেলিকপ্টার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়, যা সহজে রাডারে ধরা পড়ে না।
অভিযানের সাংকেতিক নাম রাখা হয় ‘অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার’। আর ওসামা বিন লাদেনের সাংকেতিক নাম দেওয়া ‘জ্যারোনিমো’।
অভিযানের ২৪ ঘণ্টা আগে ছিল হোয়াইট হাউস করেসপনডেন্স ডিনার। সাংবাদিকদের জন্য আয়োজিত এই বার্ষিক অনুষ্ঠানে ওবামা এমনভাবে হাস্যরস করেন যে কেউ বুঝতেই পারেনি কী ঘটতে চলছে।
‘উই গট হিম’
২০১১ সালের ১ মে রাতে হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে ওবামাসহ তাঁর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা জড়ো হন। তাঁরা সবাই ছিলেন উদ্বিগ্ন।
দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে (২ মে প্রথম প্রহর) হেলিকপ্টারে করে অভিযানিক দল পৌঁছে যায় অ্যাবোটাবাদের বাড়িটিতে। তিনতলা বাড়িটিতে প্রবেশ করে প্রথমে আবু আহমেদকে গুলি করে হত্যা করে নেভি সিল টিম-৬। এরপর দ্বিতীয় তলায় অভিযান শেষে টিম-৬ পৌঁছে যায় তৃতীয় তলা। সেখানেই ওসামা বিন লাদেনকে পাওয়া যায়। তিনি আত্মসমর্পণ না করায় তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মূল অভিযানের মিনিট বিশেকের মাথায় গ্রাউন্ড ফোর্স কমান্ডার তাঁর রেডিও যোগাযোগমাধ্যমে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার খবর পাঠান। হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমের নীরবতা ভেঙে ওবামা বলে ওঠেন, ‘উই গট হিম।’
ওসামা বিন লাদেনের মরদেহ নিয়ে হেলিকপ্টারে করে রওনা দেয় নেভি সিল টিম-৬। ফেরার সময় মার্কিন অভিযানিক দলের উপস্থিতি টের পায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। আকাশে ছুটে যায় পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো বিপদ ছাড়াই অভিযানিক দল জালালাবাদে ফিরতে সক্ষম হয়।
অভিযান সফল। সিচুয়েশন রুমে থাকা ওবামাসহ সবার মধ্যে নেমে আসে স্বস্তি। গভীর রাতে ওবামা টেলিভিশনে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন, অভিযান চালিয়ে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে। জাস্টিস হ্যাজ বিন ডান।
ওসামা বিন লাদেনের মরদেহ কী করা হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন ওবামা। শেষে তাঁর মরদেহ সাগরে সমাহিত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ওসামা বিন লাদেন অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।