এই জীবনে কখনোই কারও কাছে মাথা নত করিনি

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমা ধারাপাত হলেও নাম লিখিয়েছিলেন জানাজানি চলচ্চিত্রে। এরপর অনেক চলচ্চিত্রে নায়ক হয়েছেন। টেলিভিশন নাটকে রয়েছে তাঁর বিশাল অবদান। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করছেন তিনি। মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করেছেন একসময়। এ ছাড়া অসংখ্য বেতারনাটকেও অভিনয় করেছেন। দেশের মুক্তিযুদ্ধসহ নানা সংগ্রামে, সংকটে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। সবার প্রিয় ও ভালোবাসার সৈয়দ হাসান ইমামের আজ ৮৮তম জন্মদিন। দিনটিতে তিনি পরিবারের সবার সঙ্গে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় দীর্ঘ আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন তিনি। চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন মনজুর কাদের

সৈয়দ হাসান ইমাম
ছবি : প্রথম আলো

জন্মদিন নিয়ে ভাবনা
কোনো দিন জন্মদিন পালন করা হতো না। কেক কাটাও হতো না। তবে এই দিনে বাড়ির মধ্যে ভালো ভালো রান্না হতো। সবাই মিলে খেত, এই আরকি। কেক কাটা তো পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন। রাত ১২টা বাজলে মার্কিনদের মতো মোমবাতি জালিয়ে কেক কাটতে হবে। আমাদের দিন তো শুরু করা উচিত সকালে। আমরাও তো জন্মদিন পালন করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রভাত ফেরী’ দিয়ে। রাত ১২টায় কেক কাটা কোনোভাবে আমাদের সংস্কৃতি না।

ছোটবেলায় ফিরে তাকালে
ছেলেবেলাটা সবারই ভালো লাগে বলে আমার ধারণা। আমাকে ছেলেবেলায় কেউ কিছু করতে নিষেধ করেনি। সচেতন পরিবার। আমার মামারা কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। বড় নেতা ছিলেন। কেউই আমাদের বাধা দেননি। আমি খেলাধুলা করেছি। গানবাজনা করেছি। পরে ছাত্ররাজনীতি করেছি। কলেজে গিয়ে নাটক করেছি। আমি নিজের মতো করে বাঁচতে পেরেছি, এটাই আমার সৌভাগ্য। নিজের মতো করে বাঁচতে পারার জন্য প্রথমত নিজের ইচ্ছাশক্তি লাগে। দ্বিতীয়ত, সবার সহযোগিতা। দুটোই আমি সব সময় পেয়েছি। অনেকের পরিবার তাদের সন্তানদের বাধা দেয়, নিজের মতো করে চলতে দেয় না। আমার পরিবার তা করেনি। আমরা যেটা করতে চেয়েছি, সেটাই করেছি।

পুরোনো অ্যালবামে সৈয়দ হাসান ইমাম
ছবি : সংগৃহীত

জীবন নিয়ে ভাবনা
আমি সৎভাবে জীবন কাটানোর চেষ্টা করেছি। সেটা বর্ণাঢ্য হলো কি না, কখনো চিন্তা করে দেখি নাই। এই জীবনে আমি কখনোই কারও কাছে মাথা নত করি নাই। আমাদের সময়টুকু খুব উত্তাল ছিল। ইংরেজবিরোধী আন্দোলন। আবার দেশভাগ। সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি। এসব হিসাবে ৮৭ বছরের জীবনটা নানা সংগ্রামে পার হয়েছে। এই জীবনে অনেক প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে। দুই বছর বয়সে বাবা মারা গেলে ছোটবেলায় মা আমাদের নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। অর্থনৈতিক সংকট না থাকলেও আমি ও আমার বড় ভাইকে গড়ে তোলার একটা সংগ্রাম ছিল।

বর্ধমানের জীবন
আমার ছোটবেলা কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। নানার বাড়ি ওখানে। দুই বছর বয়সে বাবা মারা যান। বর্ধমান টাউন স্কুল, রাজ কলেজ, পরে টেকনিক্যাল কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করি। কলেজজীবন শেষ করেই ঢাকায় আসি। পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠাটা বর্ধমানে হওয়ায় বন্ধুবান্ধব সবাই ছিল ওখানেই বেশি। সেই সময়ের বন্ধুবান্ধব ঢাকায় নেই। তবে আমার বন্ধুভাগ্য ভালো। তারা আমাকে উজাড় করে ভালোবেসেছে। স্মরণেও রেখেছে। কয়েক বছর আগে বর্ধমান টাউন স্কুলের ৭৫ বছর পূর্তি করেছিল। একটা সিডি বের করেছিল। যারা পাস করেছে, ১০ জন বিখ্যাত লোক ঠাঁই পায়। আইসিএস অফিসার থেকে শুরু সেন্ট্রাল ক্যাবিনেটের মন্ত্রী পর্যন্ত ছিল। সেই সিডিতে আমার কথা ছিল ৪০ ভাগ। খেলাধুলা করতাম। ক্রিকেট, ফুটবল খেলতাম। ফুটবলে রাইট ইনসাইডে খেলতাম। ক্রিকেটে ওপেনিং ব্যাটসম্যান, উইকেটকিপার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেও খেলেছি। বেঙ্গল স্কুলে জুনিয়র গ্রুপে খেলেছি অল ইন্ডিয়া কম্পিটিশনে বিহারের বিপক্ষে, অন্যান্য স্টেটের পক্ষেও খেলেছি। আমার সঙ্গে যারা খেলেছে, সেখান থেকে একজন ভারতের ক্যাপ্টেনও হয়েছে, চুনি গোস্বামী।

বিয়ের আসরে সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসান
ছবি : সংগৃহীত

চেয়েছিলেন খেলোয়াড় হতে
খেলাটাকে প্রথম দিকে পেশা হিসেবে নেব ভেবেছিলাম। কিন্তু আরামবাগ নামে একটা জায়গায় খেলতে গেছিলাম। সেখানে বিহার কাঠিয়ার পুলিশের সঙ্গে খেলা ছিল। আমি একটা হাফভলি নিতে গেছি গোলের সামনে থেকে, পাশ থেকে আমাকে চার্জ করল। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। ডান পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেল। সে সময় তো অপারেশন ভালো ছিল না। ডাক্তার বললেন, অপারেশন করলে পা বেঁকে যেতে পারে। ডাক্তার বললেন, তুই ফুটবল খেলা ছেড়ে দে। রাতে খুব কাঁদলাম। এরপর ফুটবল খেলা ছেড়ে দিলাম। ঢাকায় এসে ক্রিকেটও ছেড়ে দিলাম।

গান-খেলাধুলা থেকে অভিনয়
আমি অভিনয় করেছি রাজনীতির কারণে। কলেজে পড়ার অনেক পরে অভিনয় শুরু করি। কংগ্রেস ছিল ক্ষমতায়। কলেজের সংসদ নির্বাচনে ছাত্র কংগ্রেসকে পরাজিত করে ছাত্র ফেডারেশন সংসদ দখল করলাম। এই সময় যখন বার্ষিক উৎসব হবে, নাটক হবে; তখন ছেলেদের মেয়ে সাজতে হতো। আমাদের সে রকম কেউ ছিল না। তখন আমাদের নেতারা বলল, তোকে অভিনয় করতে হবে। তোর হাইট বেশি না, দেখতে সুন্দর আছিস, মেয়ের চরিত্র করবি। বর্ধমান রাজ কলেজে পড়ছি। তখন একই সময়ে দুটো নাটক করি। একটি মিসর কুমারী, নারী চরিত্রে। বন্ধু বলে আরেকটা নাটকে পুরুষ চরিত্র। এরপর আমি পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করি। বর্ধমানে আমার খুব নামডাক হয়।

সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসান
ছবি : প্রথম আলো

ঢাকায় আসা
১৯৫৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসি। স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন সরস্বতীপূজা ছিল। বড় ভাই কলকাতায় পড়ছিল। আমি তখন সেটেল্ড হব বলে একাই এসেছিলাম। পৈতৃক সূত্রের যাঁরা ছিলেন, তারাও চাইছিলেন, দেশে ফিরে আসি। কেন বিদেশে থাকব। ঢাকায় এসে ফুফুর বাড়িতে শান্তিনগরে উঠলাম। আমার দাদাবাড়ি বাগেরহাটে। দাদার নাম খান বাহাদুর সৈয়দ সুলতান আলী, তিনিও রাজনীতি করতেন। ঢাকায় এসে দর্শনা সুগার মিলে যোগ দিলাম। সম্ভবত ১০-১১ মাস চাকরি করেছিলাম। সেখানে একটা ক্রিকেট টিম তৈরি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে আমার ভালো লাগত না। ছুটির দিনে ঢাকায় চলে আসতাম। তখনই একসময় ন্যাশনাল ব্যাংকের ডিরেক্টর নুরুদ্দীন আহমেদ ভাই, তিনি বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ছিলেন; তাঁরই মেয়ের জন্মদিনে আমাকে গান গাইতে ডেকেছিলেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুও ছিলেন। তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের জোনাল ম্যানেজার রশীদ সাহেবও ছিলেন। গান গাইলাম। সেখানেই নুরুদ্দীন ভাই বললেন, ‘তোর এত সুন্দর গলা, দর্শনায় পড়ে আছিস কেন?’ তুই গান শিখবি। বললাম, গান শিখব কী করে? রশীদ সাহেবকে বললেন, ‘ওকে একটা ব্যাংকে চাকরি দিয়ে দেন তো।’ তখন তো খুব সহজ ছিল। রশীদ সাহেব বললেন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের হেড অফিসে যেতে। সদরঘাটে গেলাম। জুনিয়র অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করলাম। এদিকে বর্ধমানের যারা ঢাকায় ছিল, তারা আমাকে থিয়েটারচর্চায়ও ধরে নিয়ে গেল।

মায়ের সঙ্গে সৈয়দ হাসান ইমাম
ছবি : সংগৃহীত

চলচ্চিত্রেও যুক্ত হওয়া
নারায়ণগঞ্জের সেলিম ওসমানের বাবা শামসুজ্জোহা ভাই ছিলেন ছবির প্রযোজক। ছবি প্রযোজনা করবেন, ‘জানাজানি’ নামের এই ছবির পরিচালক আলী মনসুর সাহেব। আলী মনসুর সাহেবের ছোট ভাই আলী কাওসার আমাদের সঙ্গে নাটক করত। সে-ই আমাকে নিয়ে গেল তার ভাইয়ের কাছে। স্ক্রিন টেস্ট করে আমাকে নায়ক হিসেবে সিলেক্ট করলেন। এদিকে মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন প্রধান সহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমান, ‘রাজা এলো শহরে’ ছবিতে নায়কের চরিত্রের জন্য সিলেক্ট হলাম। এরপর বশীর সাহেব নামে একজন এডিটর আমাকে ধারাপাত ছবির পরিচালক সালাউদ্দিন সাহেবের কাছে নিয়ে যান। তিনটি ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করলাম। তবে প্রথমে মুক্তি পায় ‘ধারাপাত’।