কোচবিহার থেকে বনানী, ৮৫ বছর বয়সী ফেরদৌসী রহমানকে কতটা জানেন

কোচবিহার থেকে বনানী, ৮৫ বছর বয়সী ফেরদৌসী রহমানকে কতটা জানেন
২৮ জুন ১৯৪১ সালে ভারতের কোবিহারে জন্মগ্রহণ করেন দেশের প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান। পল্লিগীতির সম্রাট আব্বাসউদ্দীন–কন্যার সংগীতের সঙ্গে বসবাস খুব ছোটবেলা থেকে। ফেরদৌসী রহমানের বাড়িতে জন্মদিন সেভাবে উদ্‌যাপন করা হতো না। বড় ভাই (সাবেক প্রধান বিচারপতি) মোস্তফা কামালের জন্মদিন হইচই করে উদ্‌যাপন করা হতো। গান হতো, কবিতা হতো, খাওয়াদাওয়া হতো। আর ফেরদৌসী রহমানের জন্মদিন প্রথম ১৯৫৬ সালে উদ্‌যাপন করা হয়, যেদিন তিনি মেট্রিকে স্ট্যান্ড করলেন, সারা দেশে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হলেন। ২৬ জুন ফল বের হয়, ২৮ জুন ছিল তাঁর জন্মদিন। সেবারই প্রথম তাঁর জন্মদিন হইচই করে পালন করা হয়। জন্মদিনে জেনে নেওয়া যাক, ফেরদৌসী রহমানের জীবনের নানা দিক
১ / ১৪
ফেরদৌসী রহমান জানালেন, বাড়িতে সেভাবে তাঁর জন্মদিন কখনোই পালন করা হতো না। বললেন, ‘তখন আমার মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিল; জন্মদিনের দুই দিন আগে; ২৬ জুন। আমি মেয়েদের মধ্যে প্রথম আর ছেলেমেয়ে উভয়ের মধ্যে সপ্তম হয়েছিলাম। আব্বা খুশি হয়ে বললেন, এবার জন্মদিন পালন করা হবে। এটাই আমার সবচেয়ে ঘটা করে জন্মদিন পালন করা। পল্টনের বাসায় অনেকে এলেন। গান হলো, কবিতা আবৃত্তি হলো। পরে আর কখনো সেভাবে জন্মদিন পালন করা হয়নি। চ্যানেল আই মাঝেমধ্যে জন্মদিনের অনুষ্ঠান করত। বাড়িতেও খুবই সীমিত আয়োজনে হয়তো কিছু করেছি। তবে ঘটা করে জন্মদিন পালন আর হয়নি।
২ / ১৪
ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর পল্টনের বাসায় আব্বার সঙ্গে ফেরদৌসী রহমান। ১৯৪১ সালের ২৮ জুন পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে জন্ম ফেরদৌসীর। বাড়ির নাম ছিল হিরামন মঞ্জিল। বাবা আব্বাসউদ্দীনের মায়ের নামেই সেই বাড়ির নাম রাখা হয়। জানা যায়, কোচবিহারে থাকতে বাড়ির বারান্দায় সবাই মিলে গান গাইতেন। মায়ের সঙ্গে ফেরদৌসী রহমান গাইতেন ‘রাতেরও ময়ূর ছড়ালো যে পাখা আকাশের নীল গায় ...।’
৩ / ১৪
ফেরদৌসী রহমান জানালেন, ঝড়ের দিনে হিরামন মঞ্জিলের বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করে দিতেন বাবা আব্বাসউদ্দীন। কারণ তিনি, ঝড় খুব ভয় পেতেন। ঝড়ের সেই সময়ে হারমোনিয়াম নিয়ে গাইতে বসতেন ফেরদৌসী রহমান। মায়ের কাছে গান শেখার শুরু। বাড়িতে সারাক্ষণ কলের গান বাজত।  ৪ বছর বয়সে কোচবিহার থেকে কলকাতায় চলে যান। ঠিকানা তখন ৬ নং বেনিয়াপুকুর লেন।
৪ / ১৪
মা লুৎফুন্নেসা আব্বাসের সঙ্গে মেয়ে ফেরদৌসী রহমান। ফেরদৌসী রহমানের প্রথম স্টেজ শো ছয় বছর বয়সে। মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তন কলকাতায়। বাবা আব্বাসউদ্দীনের শো ছিল। বাবা গান গাওয়ার আগে মেয়েকে গাইতে দিয়েছিলেন। সেদিন টেবিল ওপর ওঠে মাইকের নাগাল পান তিনি। ‘শুধু কাঙালের মতো চেয়েছিনু তাঁর মালাখানি...’ গানটি গাওয়ার পর করতালিতে অভিবাদন জানান উপস্থিত সবাই।
৫ / ১৪
১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় বাংলাদেশে আসেন। ঋষিকেশ দাশ লেনে বসবাস শুরু করেন। পড়াশোনার শুরু সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার কনভেন্ট স্কুলে, সব সময় সেরা তিনজনের মধ্যে থাকতেন। ১৯৫৬ সালে বাংলাবাজার গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সম্মিলিত মেধাতালিকায় সপ্তম স্থান অর্জন করেন এবং এর জন্য স্বর্ণপদক লাভ করেন। দুই বছর পর, ১৯৫৮ সালে তিনি ইডেন গার্লস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বাদশ স্থান অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন যথাক্রমে ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে। ১৯৬৩ সালে তিনি সংগীতে ইউনেসকো ফেলোশিপ লাভ করেন এবং লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিকে ছয় মাস ধরে স্টাফ নোটেশন শেখেন।
৬ / ১৪
বাবা বিখ্যাত সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও মা বেগম লুৎফুন্নেসা আব্বাসের সঙ্গে ফেরদৌসী রহমান। ১৯৫৯ সালে। পুরোনো ঢাকার ঋষিকেশ দাশ লেন, ভিক্টোরিয়া পার্ক হয়ে একসময় পল্টন এলাকায় নিজেদের বাড়িতে ওঠেন। ৫৫ বছরের বেশি ধরে আছেন ঢাকার বনানীর মেলোডি গার্ডেন নামের বাড়িতে। বিয়ের তিন বছরের মাথায় বাড়িটি বানানো হয়। তারপর নাম প্রস্তাব করা হয়। ফেরদৌসী রহমান তিনটি নাম প্রস্তাব করেন, সেখান থেকেই মেলোডি গার্ডেন শেষ পর্যন্ত রাখা হয়। সেই থেকে এখনো মেলোডি গার্ডেনে আছেন দেশবরেণ্যে এই শিল্পী।
৭ / ১৪
বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় স্বামী রেজাউর রহমানের সঙ্গে ফেরদৌসী রহমান। ১৯৬৬ সালে ফেরদৌসী রহমান বিয়ে করেন প্রকৌশলী ও শিল্পপতি রেজাউর রহমানকে। ওই বছরের ২৬ অক্টোবর হোটেল শাহবাগে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে) তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। তাঁদের দুই পুত্রসন্তান—রুবাইয়াত ও রাজিন। বড় ছেলে রুবাইয়াত রহমান ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে এমবিএ এবং টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটি থেকে এমআইএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি ডালাসে কর্মরত। তাঁর স্ত্রী শারমিনা রহমান একজন এমবিএ এবং এমআইএস ডিগ্রিধারী পেশাজীবী, তিনিও ডালাসে কর্মরত। এ দম্পতির একটি কন্যা রিয়াশা এবং দুটি পুত্রসন্তান—রাহিল ও রাফান।
৮ / ১৪
২০১৪ সালে ছোট ছেলে রাজিন রহমান ও তাঁর স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে ফেরদৌসী রহমান ও রেজাউর রহমান। ছোট ছেলে রাজিন রহমান বোম্বে আইআইটি থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক এবং আইবিএ থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি আগে মস্কোতে প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্সে কাজ করতেন, বর্তমানে লন্ডনে কর্মরত। সদ্যই তাঁর বিয়ে হয়েছে সাদিয়া রহমানের সঙ্গে, যিনি সমাজবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস এবং বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনেও স্নাতক। তাঁদের এক কন্যা, নাম তাসমিয়া।
৯ / ১৪
‘আমার মা বেঁচে ছিলেন ৯০ বছর। ফুফু আম্মা ৯৪ বছরের বেশি। আমি ভেবেছিলাম, বয়স হয়তো ৬০-৭০ হবে। কিন্তু কীভাবে যে এতটা বেলা হয়ে গেছে, টেরই পেলাম না। এবার আমি ৮৫ বছরে পা দেব।’ গতকাল শুক্রবার বিকেলে এভাবেই বলছিলেন ফেরদৌসী রহমান। ৮০ বছর পার করার পর প্রতিটি দিন বাড়তি পাওনা মনে করছেন ফেরদৌসী রহমান। বিষয়টির ব্যাখ্যা এভাবেই করলেন তিনি। বললেন, ‘আশির পর এখন প্রতিটি দিন আল্লাহর কাছে বোনাস মনে হয়। আমাদের দেশে একটা সময় গড় আয়ু কত ছিল? আগে তো ৫০-৬০ হলেই মানুষ বুড়ো হয়ে যেত। আমার আব্বা মারা গেছেন ৫৯ বছর বয়সে। সেই তুলনায় আমি ৬৯, ৭৯ পেরিয়ে এখন ৮৫-তে পড়লাম। আব্বার চেয়ে প্রায় ২৫ বছর বেশি জীবন পেলাম, তাই না।’
১০ / ১৪
ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও ফেরদৌসী রহমান। গত এক বছরে ফেরদৌসী রহমান তিনজন আপন মানুষকে হারিয়েছেন। এর মধ্যে আছেন স্বামী রেজাউর রহমান, সংগীতজ্ঞ ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও ভাইয়ের স্ত্রী আসমা আব্বাসী। সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমানের জন্মদিন স্বামী নীরবে উদ্‌যাপন করলেও ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও তাঁর স্ত্রী আসমা আব্বাসী বেশ হইহুল্লোড় করতেন। ফুল আর কেক নিয়ে বনানীর বাসায় হাজির হতেন। ফেরদৌসী রহমান বললেন, ‘আমি আসলে কখনোই সেভাবে জন্মদিন নিয়ে আগ্রহী ছিলাম না। তাই পালনও করতাম না। কিন্তু আমার স্বামী খুব নীরবে নানা আয়োজন করত। ইন্ট্রোভার্ট ছিল তো, কিছু করেও চুপচাপ থাকত। আর ভাই-ভাবি যত ব্যস্তই থাকুক, জন্মদিনে কেক আর ফুল নিয়ে চলে আসত। কেক কাটতে খুব পছন্দ করত। এবার তিনজন মানুষের কেউই নেই। খুব মন খারাপ হয়। আজ বিকেলে বসে বসে তাই ভাবছিলাম, জীবন এভাবেই পার হয়ে যায়। এই দিনে তিনজনের কথা খুব মনে পড়বে।’
১১ / ১৪
অবসরে গান শোনেন ফেরদৌসী রহমান। নতুন শিল্পীদের যাঁরা টেলিভিশনে গাইতে আসেন, সবার গানই কমবেশি শোনা হয় তাঁর। উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রতি একটা দুর্বলতা আছে বলে কারও কণ্ঠে উচ্চাঙ্গসংগীত শুনলে মনটা নাকি ওদিকেই চলে যায়। খুব শুনতে ইচ্ছা করে। উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রচুর রেকর্ড ও সিডিও তাঁর কাছে আছে।
১২ / ১৪
১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় ফেরদৌসী রহমানের এ গানের পরিবেশনা দিয়েই শুরু হয় যাত্রা বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশনের। বিটিভিতে ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশজুড়ে পরিচিতি পান তিনি। ১৯৭৭ সালে সেরা সংগীত পরিচালক হিসেবে প্রথমবার জাতীয় পুরস্কার পান ফেরদৌসী রহমান। এ ছাড়া স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক পুরস্কার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, চুরুলিয়া নজরুল স্বর্ণপদকসহ আরও অসংখ্য পুরস্কার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ছবিতে প্রকৌশলী স্বামী রেজাউর রহমানের সঙ্গে সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান।
১৩ / ১৪
১৯৬০ সালে ‘আসিয়া’ নামের চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম নেপথ্য কণ্ঠ দেন। ষাট ও সত্তরের দশকের বহু চলচ্চিত্রে তিনি নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর প্লেব্যাক করা চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২৫০টির কাছাকাছি। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম রেডিওতে গান করেন। তখন তিনি রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রথম বড়দের অনুষ্ঠানে গান করেন।
১৪ / ১৪
জীবন নিয়ে ফেরদৌসী রহমান অনেক খুশি। জানালেন জীবন নিয়ে উপলব্ধির কথাও। ফেরদৌসী রহমান বললেন, ‘যদি কেউ জীবনকে সুখ হিসেবে মনে করে, তাহলে উদ্‌যাপনের। আবার কেউ যদি ভাবে এটা পানিশমেন্টের, তাহলে পানিশমেন্টের। পুরোপুরি নির্ভর করছে, কীভাবে জীবনটাকে দেখা হচ্ছে। প্রতিটি দিন যদি কারও কাছে সুন্দর হয়, তাহলে এটা অবশ্যই উদ্‌যাপনের। অন্যদিকে প্রতিটি দিন যদি কারও কাছে কষ্টের হয়, তাহলে এটা পানিশমেন্টের। তবে আমি মনে করি, জীবনটা হচ্ছে সুখ-দুঃখের একটা মিশ্রণ। ভালো-মন্দ মিলিয়েই জীবন। কারও একটু বেশি ভালো, কারও একটু কম খারাপ।’ ছবিতে ভাই মোস্তফা জামান আব্বাসীর মেয়ে সামিরা আব্বাসীর সঙ্গে ফেরদৌসী রহমান।