২০১৬: চলচ্চিত্রে কম ছবিই ব্যবসাসফল

বছরের আলোচিত ছবি ছিল আয়নাবাজি
বছরের আলোচিত ছবি ছিল আয়নাবাজি

ঢাকার মূলধারার চলচ্চিত্রনির্মাতারা ২০১৬ সালে একটু অবাকই হয়েছেন বাণিজ্যিক ঘরানার বাইরে নির্মাতা অমিতাভ রেজার আয়নাবাজি ছবিটির বাণিজ্যিক সাফল্য দেখে। ২০০৯ সালে গিয়াস উদ্দিন সেলিম পরিচালিত মনপুরা ছবিটি কল্পনাতীত বাণিজ্যিক সাফল্যের পর মূলধারার বাইরের কোনো চলচ্চিত্রনির্মাতার আয়নাবাজি ছবিটি এ বছর ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। দুটি ছবির ক্ষেত্রে লক্ষণীয়, কোনো বাণিজ্যিক চাহিদাসম্পন্ন সিনেমার দর্শক-গ্রহণযোগ্য তারকা ছিল না মনপুরাআয়নাবাজি ছবিতে।

ব্যবসাসফল ছবি শিকারি
ব্যবসাসফল ছবি শিকারি

২০১৬ সালে মূলধারার বাণিজ্যিক বিনোদননির্ভর ছবি নিয়ে প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তেমন কোনো ছবিই দর্শক আকর্ষণ করতে পারেনি। এ বছর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তির শিডিউল অনুযায়ী ৫৯টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। এর মধ্যে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের ছবি শিকারি, বাদশা দ্য ডন, হিরো ৪২০, রক্ত, বসগিরি, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনি টু, শঙ্খচিল, অনেক দামে কেনা আয়নাবাজি। এক থেকে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে রাজা ৪২০, নিয়তি, শুটার, ধূমকেতু, ওয়ানওয়ে, প্রেম কি বুঝিনি, অস্তিত্ব, মুসাফির, বাজে ছেলে, সুইটহার্ট, অঙ্গার, সম্রাট, মেন্টাল দ্য রানা পাগলা ছবিগুলো। ষাট থেকে আশি লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে মাটির পরী, ভুল যদি হয়, পুড়ে যায় মন, কৃষ্ণপক্ষ, মন জানে না মনের ঠিকানা, আইসক্রিম, অজান্তে ভালোবাসা, আড়াল, এক জবানের জমিদার হেরে গেলেন এইবার, চোখের দেখা এক পৃথিবী প্রেম ছবিগুলো।
বড় বাজেট, মধ্যম বাজেট ও তুলনামূলক কম বাজেটে নির্মিত ২০১৬ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ৫৯টি ছবির মধ্যে শিকারি, বাদশা দ্য ডন, শুটারআয়নাবাজি ছবি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয় এবং লগ্নিকৃত পুঁজি ফেরত আসে। ৫৫ ছবির পুঁজির বেশির ভাগ অর্থ ফেরত আসেনি। বড় বাজেট ও মধ্যম বাজেটের ছবির বেশির ভাগেরই বেশ কিছু ছবি লগ্নিকৃত পুঁজির অর্ধেক এবং কোনো কোনোটির দুই–তৃতীয়াংশ টাকা ফেরত আসেনি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০ থেকে ২২৫টি হলে নিয়মিত ছবি প্রদর্শিত হলেও ঈদ উৎসবে অনেক বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলেও ছবি প্রদর্শিত হয়। সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রায় ২৫০ থেকে ২৭৫টির অধিক হলে উৎসব উপলক্ষে ছবি প্রদর্শিত হয়। এর মধ্যে যেসব ছবি ১৫০-২০০টি হলে প্রদর্শিত হয়েছে এসব ছবির লগ্নিকৃত পুঁজির অর্ধেক ফেরত আসে।
এ বছর শাকিব খানের মতো জনপ্রিয় তারকার ৮টি ছবি মুক্তি পেলেও শিকারিশুটার ব্যবসাসফল হয়। বাকি ৬টি ছবির মধ্যে বসগিরি ছবি মোটামুটি ভালো চললেও বাকি ৫টি ছবির লগ্নিকৃত অর্থের বেশির ভাগ উঠে আসেনি। অন্যদিকে বাপ্পি-মাহি দর্শক গ্রহণযোগ্য জুটি ছিল। এই জুটির একটিমাত্র ছবি অনেক দামে কেনা মোটামুটি ভালো চললেও পুঁজি ফেরত আসেনি।

এ বছর যৌথ প্রযোজনায় আটটি ছবি নির্মিত ও মুক্তি পেলেও নুসরাত ফারিয়া ও জিৎ-এর বাদশা দ্য ডন, শাকিব ও শ্রাবন্তীর শিকারি এবং নতুন নায়িকা বুবলীর শুটার ব্যবসাসফল হয়। সৌভাগ্যবান অভিনেত্রী বুবলীর শাকিব খানের সঙ্গে বসগিরি শুটার ঈদুল আজহা উপলক্ষে মুক্তি পায় এবং মিডিয়ার কারণে বুবলী বেশ আলোচিত হন। কিন্তু তাঁর অভিনীত বসগিরি ছবির পুরোপুরি পুঁজি এখনো ফেরত আসেনি।

২০১৬ সালে ১২ জন নতুন পরিচালকের আত্মপ্রকাশ হলেও অমিতাভ রেজা আয়নাবাজি ও শামীম আহমেদ মেন্টাল দ্য রানা পাগলা ও বসগিরি ছবির জন্য আলোচিত হন। এ বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ৫৫টি ছবি ব্যবসাসফল না হওয়ার কারণে চলচ্চিত্র নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দর্শক হলে না যাওয়ার কারণ নির্মিত ছবিগুলোর কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য, পরিচালনার দুর্বলতা; সেই সঙ্গে রয়েছে সিনেমা হলের সার্বিক খারাপ পরিবেশ, ভিডিও পাইরেসি, ডিজিটাল সিনেমার নামে দেশের বেশির ভাগ সিনেমা হলে ইলেকট্রনিক বা ই-সিনেমা প্রদর্শনী। গত চার বছরে মোট মুক্তিপ্রাপ্ত ২৪৯টি ছবির মধ্যে মাত্র ১৭টি ছবি ব্যবসাসফল হয়। বাকি ছবিগুলো অসফল বলা যায়। ৮৭ জন নতুন পরিচালক এসেছেন গত চার বছরে ঢাকার সিনেমা শিল্পে। হাতে গোনা কয়েকজন আলোচনায় এসেছেন কিছু ভালো মানের সিনেমা নির্মাণ করে। অভিনেতা-অভিনেত্রী অনেকে চলচ্চিত্রে এসেছেন ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারাবাহিকতায়। কিন্তু এঁদের অনেকেই চলচ্চিত্রে স্থায়ী আসন করে নিতে পারেননি। ঢাকার ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য মডার্ন টেকনোলজির সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও ২০১৩ সাল থেকে দর্শক হলবিমুখ হতে থাকে। বিনোদনপ্রধান জনপ্রিয় ছবির অভাবে প্রতিবছর সিনেমা হলের সংখ্যা কমতে থাকে। চলচ্চিত্রের মতো প্রধান বিনোদন এই মাধ্যম বর্তমান সময়ে যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে এ শিল্পের বর্তমান সংকটাপন্ন অবস্থা সহসা কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম।

লেখক: চলচ্চিত্র গবেষক ও শিক্ষক