অচেনা পথে চেনা লাকী ভাই

লাকী আখান্দ্‌
লাকী আখান্দ্‌

ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কলকাতা গিয়েছিলাম। রোদে-গরমে অসুস্থ হয়ে ঢাকা ফিরলাম। পরিকল্পনা করলাম সেলফোন, ফেসবুক সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রেখে বিশ্রাম নেব—সুস্থতা জরুরি। লম্বা ঘুম দিয়ে সন্ধ্যায় উঠে দেখি অসুস্থ আমাকে দেখতে ডাক্তার বড় বোন এসেছে বাসায়। গল্পসল্পের ফাঁকে ফাঁকে বোনের চোখ ছিল ফেসবুকে। হঠাৎ স্বগতোক্তির মতো বলে উঠল, ‘ওহ! মারা গেছেন লাকী আখান্দ্‌।’ চমকে উঠলাম। কী? লাকী ভাই নেই...? মনের আকাশে ভিড় করল হাজারো স্মৃতির মেঘ।

চমৎকার মানুষ ছিলেন লাকী ভাই। ভালোবাসতেন পাহাড়। দার্জিলিংয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ, স্ট্রিট ফুড খুব পছন্দ ছিল তাঁর। সুস্থ থাকতে বেশ কয়বার প্ল্যান করেছিলাম, কয়েকজন মিলে দল বেঁধে দার্জিলিং বেড়াতে যাব। যাওয়া আর হলো কই?
কথার পিঠে কথা বলতে কিংবা খোঁচা মেরে উত্তর দিতে খুব পটু ছিলেন। একবার অফিসের একটা অনুষ্ঠানের পর সবাই মিলে ছবি তুলছি। বেতার বাংলার ক্যামেরা পারসন মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টুর ক্যামেরায় পোজ দেওয়ার সময় আমার পাশে দাঁড়িয়ে মজা করে বললেন, ‘পাশে দাঁড়ালে হাসব্যান্ড মাইন্ড করবে না তো?’ (আমার হাসব্যান্ড লাকী ভাইয়ের কঠিন ভক্ত, তিনি সেটা জানতেন।) আমি উত্তরে বললাম, ‘এ রকম বুড়ার সঙ্গে ছবি তুললে মাইন্ড করার প্রশ্নই আসে না।’ সঙ্গে সঙ্গে চটপট উত্তর, ‘ওকে, তাহলে দাঁড়াই, বুড়ির সঙ্গে ছবি তোলার আমাদেরও অবজেকশন নেই।’ তুললাম ছবি, শাহবাগ বেতার অফিসের বাগানের সামনে। হয়তো তখন থেকেই রোগটা বাসা বেঁধেছিল তার শরীরে..., সবার অজা‌ন্তে...।
আরেকটা কথাও আজ বেশ মনে পড়ছে। সম্ভবত ২০০০ সাল, এশিয়া প্যাসিফিক ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন (আবু) আয়োজিত একটা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বেতার অনুষ্ঠান তৈরি করে পাঠাতে হবে। আমার সঙ্গে কাজ করবেন লাকী ভাই। ১২ টায় রেকর্ডিং। বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে বসে আছি অপেক্ষায়। লাকী ভাই আসলেন দুপুর ২টায়। খানিকটা রাগ করেই বললাম, ‘আপনি যদি দুইটাতেই আসবেন, তাহলে দুইটাতেই টাইম দিতেন, ১২টা বললেন কেন? শিল্পীরা দু’ঘন্টা ধরে বসে আছে।’
লাকী ভাই চুপচাপ। পরে অবশ্য অফিস টাইম শেষ হওয়ার পর দু’ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় কাজ করে অনুষ্ঠানটা শেষ করেছিলেন।
মায়ের কথা বলতেন খুব। মেয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর আস্থার কথা প্রকাশ পেত আলাপচারিতায়। ‘মেয়ে “মামিনতি”র মিউজিক সেন্স অসাধারণ, খুব ম্যাচিউরড’—গল্পে গল্পে বলেছিলেন বহু আগে, মেয়ে তখনো অনেক ছোট। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মামিনতি মানে কী?’ উত্তরে বলেছিলেন, ‘মা-মিষ্টি’ বা ‘মিষ্টি মা’। এর প্রায় এক দশক পর এসএমএস করে জানিয়েছিলেন একটা প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে মামিনতির সঙ্গে তার লাইভ গানের অনুষ্ঠানের কথা। আশ্চর্য! সময় কি দ্রুত চলে যায়...।
কত যে স্মৃতি তাঁকে ঘিরে। ২০০৮ থেকে ২০১০ নরওয়ে সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে একটা কোর্স করতে দুই বছর বেতারের বাইরে ছিলাম। কোর্স শেষে বেতারে ফিরেছি শুনেই দেখা করতে এসেছিলেন লাকী ভাই। মিটিংয়ে ছিলাম, দেখা হয়নি। মিটিং শেষে দুপুরের দিকে রুমে ফিরতেই পিয়ন বলল, ‘একজন এসেছিল আপনার কাছে, এইটা দিয়ে গেছে।’ বলে একটা চিরকুট দেখাল। তাকিয়ে দেখি, লাকী ভাইয়ের লেখা আশীর্বাদ মাখা শুভকামনা বার্তা। খুব ভালো লাগল ওটা পেয়ে। কিছুটা খামখেয়ালি, উদাস মনের এই মানুষটা ঠিকই খোঁজ খবর রাখেন আমাদের, যাদের তিনি কাছের মানুষ মনে করেন।’
আর তিনি...? শুধু আমার কেন? গোটা বাংলাদেশের সংগীতপ্রেমী মানুষের কাছের মানুষ, অতি আপনজন। সুরে সুরে জাদু মেখে যিনি কাছে টানেন সবাইকে। আজ এই কাছের মানুষ, সুরের জাদুকর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে, তাকে আর ফেরানোই গেল না। শুভ কামনা আর আশীর্বাদ আপনার জন্যও লাকী ভাই—আমাদের সবার পক্ষ থেকে।
রওনক জাহান: উপপরিচালক, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট