হলে গিয়ে 'রাজনীতি' দেখুন

রাজনীতি ছবিতে শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস
রাজনীতি ছবিতে শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস

‘একটা ভোট ফালাইলে যদি আমার এক লক্ষ ভোট আহে, তাইলে ওই রকম দশটা ভোটের বলি দিতেও আমার এই হাত কাঁপব না। মনে রাখবা এই নীতি, ওই নীতি, দুনিয়ার সব নীতির ওপরে একটাই নীতি, সেইটা হইল রাজনীতি।’

চাঁদ সরদাররূপী সাদেক বাচ্চুর এই সংলাপটি দিয়ে রাজনীতি চলচ্চিত্রের গল্প শুরু। সংলাপটি শুনতে খারাপ লাগলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের রাজনীতি এই নীতিতেই চলছে।

উল্টো দিকে অয়নরূপী শাকিব খান যখন বলেন, ‘আপনারা জানেন, জনতা পার্টি বরাবরই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাই তো মায়ের পেটের ভাইকে আইনের হাতে তুলে দিতে আমি পিছপা হইনি।’ এই সংলাপের মাধ্যমে আবার আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার প্রকাশ পায়।

আসলে রাজনীতি হচ্ছে মানুষের কল্যাণের জন্য, সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য, যা রাজনীতি চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। ধন্যবাদ সংলাপ রচয়িতা বুলবুল বিশ্বাস ও দেলোয়ার হোসেনকে।

সেট

এই চলচ্চিত্রে সবচেয়ে নান্দনিক দিক হচ্ছে সেট ও প্রপসের ব্যবহার, যা প্রতিমুহূর্তেই লক্ষণীয়। শাঁখারীবাজারের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায় এফডিসির ভেতরে, যা প্রশংসার যোগ্য। ধন্যবাদ ডিজাইনার উত্তম গুহকে।

চরিত্রায়ণ

সঠিক চরিত্র রূপায়ণ একটি গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে তার উত্কৃষ্ট উদাহরণই হলো রাজনীতি। আলী রাজ ও সাদেক বাচ্চু সরকারি ও বিরোধী দলের দলপ্রধানের চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে চরিত্র দুটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন। সেই সঙ্গে নাজিম উদ্দিন চরিত্ররূপী শিবা সানুকে নতুনভাবে পর্দায় দেখলাম। কী দারুণ অভিব্যক্তি, কী দারুণ ব্যক্তিত্ব। সানু বেগমের চরিত্রে সাবেরি আলমের স্বাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে চরিত্রটির যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। অমিত হাসান শুরু থেকেই ঠান্ডা মাথায় জব্বর মিয়া চরিত্রটি টেনে নিয়ে গেছেন, যা চরিত্রের গভীরে যে আরেকটি চরিত্র আছে তা বুঝতেই দেননি। কিন্তু শেষ দৃশ্যে আরেকটু পরিমিতি বোধ বজায় রেখে অভিনয় করলে আরও ভালো লাগত। বুলেট চরিত্রে কমল পাটেকার, আরতি বউদির চরিত্রে লাবণ্য লিসার অভিনয় দৃষ্টি কেড়েছে। শাকিব-অপুর রসায়ন বরাবরের মতোই গ্রহণযোগ্য। বিশেষ কিছু জায়গায় নাম্বার ওয়ান হিরো আবারও নাম্বার ওয়ানের ছাপ রেখেছেন। সাউথ আফ্রিকার উঁচু পাহাড়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ‘আই অ্যাম টপ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ সংলাপটি যখন বলে, তখন দেশপ্রেমিকের পরিচয় পাওয়া যায়। রাজনীতিবিদ হয়ে বলা, ‘চাঁদ সরদার, তোমার ঘোড়ার লাগাম এখন আমার হাতে। আমি লাগাম ছেড়ে দিলাম, এখন তোমার ঘোড়া তোমাকেই দৌড়াবে।’ সংলাপটিও যথার্থ মানানসই।

ছবিটির বড় টেক্কা হলো আনিসুর রহমান মিলন। মিলন ভার্সেটাইল অভিনেতা এটা জানতাম, কিন্তু এই চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে নতুনভাবে তাঁকে আবিষ্কার করলাম। প্রেম, সংঘাত, দ্বন্দ্ব, আবেগ ও হাস্যরসাত্মক দৃশ্যে প্রতিটি মুহূর্তে মিলনের যথার্থ অভিনয় দর্শককে মুগ্ধ করেছে। প্রয়াত শক্তিমান অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির শূন্যস্থান পূরণ করা একমাত্র মিলনের পক্ষে সম্ভব।

রাজনীতি
পরিচালক: বুলবুল বিশ্বাস
অভিনয়: শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, আনিসুর রহমান মিলন, সাদেক বাচ্চু, অমিত হাসান
প্রযোজনা: অ্যারো মোশন আর্টস

গান

অপ্রয়োজনে কোনো গান ব্যবহার হয়নি। প্রতিটি গানই শ্রুতিমধুর ও দৃষ্টিনন্দন। গীতিকার থেকে শুরু করে সুর ও সংগীতায়োজন আর গায়কিতে সবাই যে যাঁর মতো যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশেষ করে কবির বকুলের কথায়, হাবিব ওয়াহিদের সুর ও সংগীত এবং মাসুম বাবুলের কোরিওগ্রাফিতে ‘ও আকাশ বলে দে নারে, প্রেমে পড়েছে মন’ গানটি আমার খুবই ভালো লেগেছে। আরেকটি গানের কথা তো আমি ভুলতেই পারছি না, ‘এ কোন ইবাদত দেখালি হে কুদরত’। অপু বিশ্বাসকে দেখার পর মিলনের অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে গানটির কোনো জবাব নেই। আর ‘রঙে রঙে মনের রঙে’ শীর্ষক হলির গানটিতে কয়েকটি ক্লোজ আপ শটে অপু বিশ্বাসকে অসম্ভব সুন্দর লেগেছে। সে জন্য ধন্যবাদ কোরিওগ্রাফার হাবিব, সিনেমাটোগ্রাফার আসাদুজ্জামান মজনু ও সম্পাদক তৌহিদ হোসেন চৌধুরীকে। কিন্তু ‘তোমার এই মন আমাকে দিয়ো’ গানটির চিত্রায়ণ আউটডোরকে প্রাধান্য দিলে বেশি ভালো লাগত। আইটেম সংয়ে বিপাশার উপস্থিতি বরাবরের মতোই, আর আরিফ রোহানের কোরিওগ্রাফি গতানুগতিক ছিল। তবে এ গানটির গায়কিতে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন দিনাত জাহান মুন্নী। এ ছাড়া আবহ সংগীত এক কথায় দুর্দান্ত। আমার মনে হয়, ইমন সাহা পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে টিকে থাকতে পারবেন সারা জীবন।

নির্মাণ

নির্মাণশৈলী, নান্দনিকতা, পরিমিতি বোধ, চিত্রনাট্যের দক্ষতা কখনো বুঝতে দেয়নি যে রাজনীতি চলচ্চিত্রটি বুলবুল বিশ্বাসের প্রথম চলচ্চিত্র। দর্শক হিসেবে যা ভেবেছি হয়েছে তার উল্টো—বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল, গ্রহণযোগ্যতা ছিল, চমকপ্রদ ছিল। অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তী চলচ্চিত্রটি দেখার।

প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান

রাজনীতি চলচ্চিত্রটির প্রযোজক একজন নবীন পরিচালককে দিয়ে যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা প্রশংসার যোগ্য। যেখানে যা প্রয়োজন তার পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। এ ধরনের প্রযোজক ইন্ডাস্ট্রিতে প্রয়োজন। যাঁরা বাংলাদেশের বাংলা চলচ্চিত্র দেখে অভ্যস্ত, যৌথ প্রযোজনার ছবি দেখতে আগ্রহী তাঁরাও একবার হলে গিয়ে রাজনীতি দেখুন। আশা করি নিরাশ হবেন না।

শেষ করার আগে একটি সংলাপ খুব মনে পড়ছে, যা অসুস্থ অবস্থায় আনিসুর রহমান মিলন বলেন শাকিব খানকে। ‘আমার এই দিলডা দিয়া তোরে ভালোবাসিরে ভাই, তোরে কত্ত দিন এই বুকটায় লিয়া ঘুমাই না, কেমন জানি শীত শীত লাগতাছে, আমারে একটু বুকের মইধ্যে জড়াইয়া রাখবি ভাই...?’

লেখক: নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা