সার্থক হলো বর্ষা উৎসব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় শুক্রবার সকালে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত বর্ষা উৎসবে নৃত্যশিল্পীদের পরিবেশনা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় শুক্রবার সকালে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত বর্ষা উৎসবে নৃত্যশিল্পীদের পরিবেশনা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বর্ষার একটি নিজস্ব সুর আছে। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ, দমকা হওয়া শনশন, গাছগাছালির পাতায় পাতায় ঝোড়ো হাওয়া ঝাপটায় সড় সড় আওয়াজ আর ক্ষুরধারা ভরা নদীর কলকল ছলছল স্রোতধ্বনি মিলেমিশে রচিত সেই সুর। নগরজীবনে এসব সুর পাওয়া কঠিন। তাই বলে গানের সুর, নৃত্যের তালে বর্ষাবন্দনা করতে দোষ কি আছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় আজ শুক্রবার সকালে বর্ষা উৎসবের আয়োজন করে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। এ আয়োজনে ছিল আলোচনা, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তিসহ পরিবেশ রক্ষায় বিনা মূল্যে চারা বিতরণসহ বৈচিত্র্যময় নানা কর্মসূচি।

ভোরের ঝুম বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে একাকার ছিল চারুকলার সবুজ প্রাঙ্গণ। একটু বাতাসে গাছের পাতায় জমে থাকা পানি ভিজিয়ে দিচ্ছিল মঞ্চের শিল্পী এবং সামনে থাকা দর্শকদের। উৎসবে আকাশি-নীল রঙের শাড়ি আর খোঁপায় ফুল গুঁজে সেজেছিলেন মেয়েরা। ছেলেদের পোশাকেও ছিল বর্ষার সৌন্দর্য নীল পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। কেউ কেউ বর্ষার কবিতার পঙ্‌ক্তি আর ছবি-সংবলিত টি-শার্ট পরেও এসেছিলেন। সব মিলে সার্থক বলা যায় বর্ষার উৎসবটিকে।

বিজন চন্দ্র মিস্ত্রীর পরিবেশনায় রাগসংগীত দিয়ে শুরু হয় বর্ষা উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। এরপর রবীন্দ্রনাথের ‘মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো’ গানের সঙ্গে স্পন্দনের শিল্পীরা দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন। আবৃত্তিশিল্পী মাসকুর-এ-সাত্তার শোনান শামসুর রাহমানের কবিতা।

সত্যেন শিল্পী শিল্পীগোষ্ঠীর দলীয় পরিবেশনা ‘এসো শ্যামল সুন্দর’-এর পর রবীন্দ্রসংগীত ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যজনের শিল্পীরা।

বৃষ্টি মানবমনকে উদাস করে তোলে। নিঃসঙ্গতা বোধকেও করে তোলে তীব্র। বহ্নিশিখার শিল্পীরা নজরুল ‘মেঘের ডমরু ঘন বাজে’ গানে বর্ষার সেই রূপটিকেই ফুটিয়ে তুললেন।

অনুষ্ঠানে জয় গোস্বামীর ‘মেঘবালিকার জন্য রূপকথা’ শোনান নায়লা তারান্নুম চৌধুরী। সংগীতশিল্পী আবু বকর সিদ্দিক শোনান উকিল মুন্সীর গান ‌‘‌‌আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে’, মামুন জাহিদ খান শোনান আধুনিক গান ‘‌বরষা তুমি অমনভাবে ঝরো না’ ইত্যাদি গান।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা-পর্বেই সীতাকুণ্ডে পাহাড়ধসে শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যুর খবর আসে। হরিষে নামল বিষাদ। বর্ষাকথন-পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের কণ্ঠেও সেই সুর। প্রকৃতি সুরক্ষার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‌‘আমরা আশা করব, মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবেসে প্রকৃতি সুরক্ষা, ঋতুবৈচিত্র্য রক্ষায় যা কিছু প্রয়োজনীয়-করণীয়; সবকিছু করবে। প্রকৃতির ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন বন্ধে তারা আরও সচেতন হবে।’ ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশে নাগরিকেরা বর্ষা উৎসবে যোগ দিয়ে বর্ষার মতো সজীব আর উদার হয়ে উঠবেন বলেও প্রত্যাশা করেন তিনি।

অনুষ্ঠানের আরেক অতিথি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘বর্ষা বাঙালির জীবনে এক আশীর্বাদ। আমাদের বোকামি আর অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে বর্ষা হয়ে উঠে অভিশাপ। খালবিল ভরাট করছি, নদীগুলো ঠিকমতো ড্রেজিং হচ্ছে না, ভরাট হচ্ছে। বর্ষাকে আসলে যেভাবে গ্রহণ করা উচিত, আমরা তা করছি না। বর্ষাকে, প্রকৃতিকে মানুষের কাজে ব্যবহার করতে হবে।’

অনুষ্ঠানের সভাপতি সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সহসভাপতি অধ্যাপক নিগার চৌধুরী বলেন, বর্ষা উৎসবের মতো অসাম্প্রদায়িক উৎসবে যোগ দিয়ে উৎসবপ্রিয় বাঙালিরা সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হবেন, তাঁরাই প্রতিহত করবেন সাম্প্রদায়িকতা।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজারুল ইসলাম।