বড় মাপের অনুপ্রেরণা

হুমায়ুন সাধু। ছবি: সুমন ইউসুফ
হুমায়ুন সাধু। ছবি: সুমন ইউসুফ

আপনার অনুপ্রেরণা কে? সাবলীল সাক্ষাৎকারের ঠিক এই প্রশ্নে এসেই আটকে গেলেন নির্মাতা। কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ‘আমার সামনে তো কখনো কোনো অনুপ্রেরণা ছিল না।’ এগিয়ে চলার পথে এ-ই একমাত্র প্রতিকূলতা ছিল হুমায়ুন সাধুর। বাকি সব বাধাবিপত্তি তিনি আমলে নেননি কখনো। কিন্তু অনুপ্রেরণা না থাকার তাড়না তাঁকে এখন অনেকের চোখে এক বড় মাপের অনুপ্রেরণা হিসেবে তুলে ধরেছে।

হাসিখুশি মানুষটা গত ঈদুল ফিতরে হাস্যরসের মধ্য দিয়ে এক রূঢ় বৈষম্যের গল্প দেখিয়েছেন নাটকে। ‘চিকন পিনের চার্জার’ জিনিসটা নিয়ে প্রচুর হাসিতামাশা হলেও কিছু সময়ে এর গুরুত্ব কত বেশি—এই নাটকীয়তার বয়ান করতে করতে ‘বডি শেমিং’য়ের মতো আলোচিত ইস্যুকে নাটকে তুলে ধরেছেন। দেহগড়ন আর বর্ণ নিয়ে কাউকে উপহাস আর তাচ্ছিল্য করাকে ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে ‘বডি শেমিং’। মোটা-চিকন, লম্বা-খাটো, ছোট-বড় আর ফরসা-কালো নিয়ে আমাদের বাছ-বিচারের শেষ নেই। এই বৈষম্যের শিকার কমবেশি অনেকেই হয়। হুমায়ুন সাধুও হয়েছেন। তবে ‘চিকন পিনের চার্জার’ সরাসরি তাঁর গল্প নয়, তাঁর একটি ছোট্ট অভিজ্ঞতার গল্প, তাঁরই লেখা। নির্মাতা হুমায়ুন সাধু অভিনয় দিয়েও এই নাটকে নজর কেড়েছেন সবার। তাই সব মিলিয়ে ঈদের পর থেকে এখন পর্যন্ত তাঁর নাটক চিকন পিনের চার্জার-এর প্রশংসায় তিনি ভেসে যাচ্ছেন। এমনকি বড় ভাইবোনেরাও যখন হুমায়ুন সাধুকে এসে বলেছেন, ‘আমারও অভিনয়ের সাধ ছিল, কিন্তু কিছু করতে পারলাম না। তুই আমাদের স্বপ্নপূরণ করে দেখালি।’ তখন মনে হয়, নাহ! কোনো একটা গতি হলো তবে।

আড্ডায় বসে হুমায়ুন সাধু বারবার বলছিলেন, এসব তাঁর কাছে অপ্রত্যাশিত। তাঁর পরিচালিত ৭ নম্বর নাটক চিকন পিনের চার্জার। নাটক বানিয়ে তিনি যে এমন পরিচিতি পাবেন, তা নাকি তাঁর কাছে কল্পনাতীত। কারণ বরাবরই তাঁর মনে হতো, তাঁকে দিয়ে কিছু হবে না। তাই কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই করে যেতেন কাজ। কিন্তু এবার এমন সাড়া পেয়ে তিনি এখন নড়েচড়ে বসেছেন। ভাবছেন সামনের দিনগুলো নিয়ে। দেখছেন সিনেমা বানানোর স্বপ্ন।

কিন্তু ঘুরেফিরে আবারও সেই প্রশ্নে ফিরে এলাম আমরা? কেন কোনো অনুপ্রেরণা ছিল না হুমায়ুন সাধুর? তিনি বললেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে আমার মতো একজনের এই ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত আমার সামনে ছিল না। কাকে দেখে আমি নতুন কিছুর চেষ্টা করব? তাই কখনো আশাই করিনি যে আমাকে দিয়ে ভালো কিছু হবে।’

 ৯ ভাইবোনের মধ্যে হুমায়ুন সাধু ৭ নম্বর। চট্টগ্রামে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার হামলার পরপর তাঁদের পরিবারে একটি বিপর্যয় আসে। তখন নিজের তাগিদেই বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন সাধু। কয়েক দিন কাটান রেলস্টেশনে, বাসস্টেশনে ঠিকানাহীনভাবে। এরপর একটা সময় কাজ শুরু করেন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সহকারী পরিচালক হিসেবে। পাশাপাশি লেখালেখি করতে থাকেন। নিজের জীবনে ও আশপাশে ঘটে যাওয়া মজার সব ঘটনা কাগজে টুকে রাখার শখ তাঁর। লেখালেখির পাগলামির কথা জানাতে গিয়ে সাধু বলেন, ‘আমার যে কত গল্প জমা আছে। আমি সময়ে-অসময়ে খালি লিখি।’ তাহলে এই লেখাগুলো বই আকারে আসে না কেন? এ প্রশ্ন শুনেই হুমায়ুন সাধু হেসে উঠলেন যেন মজার কোনো কৌতুক শুনলেন। বললেন, ‘আমার লেখা কে পড়বে? আমি ছোট-বড় সব লেখকের বই পড়ি। আমিও যদি বই বের করি তাহলে তো প্রিয় লেখকদের সামনে লজ্জায় পড়ে যাব!’ এখানেও ইতস্তত হুমায়ুন সাধু। কারণ, লেখার দুনিয়ায়ও তাঁর কোনো অনুপ্রেরণা নেই। কিন্তু এ নির্মাতা আর অভিনেতাকে কে বোঝাবেন যে, তিনি নিজেই তো এখন এক বড় মাপের অনুপ্রেরণা।