বদলে যাননি তাহসান, তবে...

এই মুহূর্তে তাহসানের ধ্যানজ্ঞান একটাই—অ্যালবাম। ছবি: কবির হোসেন
এই মুহূর্তে তাহসানের ধ্যানজ্ঞান একটাই—অ্যালবাম। ছবি: কবির হোসেন
কিছু আনন্দ, কিছু দুঃখ, কিছু হর্ষ, কিছু বিষাদ—সব রকম নিয়েই তাহসান। মূলত সংগীতশিল্পী। অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা পেলেন। গেল ঈদে ছোট পর্দায় ৬টি নাটক নিয়ে হাজির ছিলেন। আসছে ঈদে একটাও না। কেন নাটক করা হয়নি, কী করছেন তাহসান, কী ভাবছেন—সেদিন সন্ধ্যায় পরীবাগের বাসায় আড্ডা দিয়ে সেসব জানলেন মাসুম আলী

‘অনেক কথা যাও যে বলে কোন কথা না বলি’—দীর্ঘদিন পর তাহসানের সঙ্গে আড্ডা শেষে রবীন্দ্রনাথকেই মনে পড়ল। সেদিন ছিল শুক্রবার, ঘড়িতে আটটা বেজে কুড়ি মিনিট। একটু আগে একটি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সংগীতবিষয়ক অ্যাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নিজের পরবর্তী ও সপ্তম অ্যালবাম অভিমান আমার মুক্তির ঘোষণা দিয়ে এসেছেন। সেই অ্যালবামের বিস্তারিত জানালেন আড্ডায়। অল্প করে বললেন গত ১৫ বছরের প্রাপ্তি, আগামী ১৫ বছরের পরিকল্পনা বা স্বপ্নর কথা।

হালকা চিনিতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বেশ কয়েকবার দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন তাহসান। একটু তাড়া আছে, বলছে তাঁর শরীরী ভাষা। ক্যারিয়ারে ১৫টি বছর কেটে গেল। ১৫ বছর আগে যাঁরা তাহসানকে দেখেছিলেন, তাঁরা এখন দেখলে প্রথমেই ধরে নেবেন, কই, একটুও তো বদলায়নি ছেলেটা।

বটেই। চর্মচক্ষু দর্শনে তেমন একটা পরিবর্তন দেখা যাবে না। সংযত, ভদ্র বাচনের মানুষ। পোশাক-পরিচ্ছদে পরিপাটি। কেতাদুরস্ত বলতে যা বোঝায়, তেমনটাই থাকেন বাসার বাইরে। আগেও এমনটাই ছিলেন। মিন্টো রোডের সরকারি বাংলোয়, পরীবাগের বাসায়, গুলশানের বাসায়। এখন থাকেন পরীবাগের বাসায়। মা-বাবার সঙ্গে।

তবে চিন্তার জগতে বেশ খানিকটা বদলে গেছেন তাহসান। হবে না কেন? গত ১৫ বছরে সূর্যকে পৃথিবী ১৫ বার প্রদক্ষিণ করার সাক্ষী শুধু নন তিনি, আরও অনেক কিছুই ঘটে গেছে তাহসানের জীবনে। গান দিয়ে শুরু করেছিলেন। কিন্তু একটা সময় অভিনেতা হিসেবে ছোট পর্দায় রীতিমতো অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন ছায়ানটে রবীন্দ্রসংগীতে তালিম নেওয়া এ শিল্পী। গত কয়েক বছরে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা কার্লসন স্কুল অব ম্যানেজমেন্টে ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্টের ওপর বিশেষ ডিগ্রি নেন। বিয়ে করে সংসারী হন। মেয়ের বাবা হন। একসময় আবার ভেবেচিন্তে ঘোষণা দিয়ে পরিবারজীবনে একা থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

একা? ঠিক একা নন। আড্ডার ফাঁকে তাহসান জানান, এখন মা-বাবাকে বেশি সময় দিচ্ছেন। আর মেয়ে। মেয়ের জন্য গান, অভিনয় সব ছেড়ে দিতে রাজি বাবা তাহসান। এটা তাঁর নিজেরই মন্তব্য।

বিয়ে, বিচ্ছেদ নিয়ে কথা হবে না—এমন শর্তে প্রথম আলোর আনন্দের জন্য সময় বের করেন তাহসান। শর্ত মেনেই আড্ডা চলতে থাকে। বিস্কুট, চানাচুর সঙ্গে নানা রকমের ফল আসে। চানাচুর খেতে খেতে আরও কয়েকবার ঘড়ির দিকে তাকান। না বললেও বুঝতে বাকি নেই, তাহসানের তাড়া আছে।

এত ব্যস্ততা কী নিয়ে, এখন তাহসান কী করছেন? এবার যে তথ্য দিলেন, তা ভক্ত-শ্রোতার জন্য সবচেয়ে বড় সুখের খবর। এই মুহূর্তে তাহসানের ধ্যানজ্ঞান একটাই—অ্যালবাম। ঈদ সামনে রেখে তাহসান তাঁর একক অ্যালবামের কাজ করছেন। এটি তাঁর সপ্তম অ্যালবাম, সাতটি নতুন গান করছেন এই অ্যালবামে জন্য।

অ্যালবামের সূত্র ধরেই এগিয়ে যান তাহসান। এখন তিনি কেমন আছেন, কী ভাবছেন, মনের অবস্থা কী—এসবই পাওয়া যাবে এই অ্যালবামের সাতটি গানে। সব কটি গানের কথা ও সুর নিজের। নতুন এ সাতটি গানের কথায় তাহসানের ভাবনার বিস্তারিত আছে। কেননা গানগুলো তাঁর মন থেকেই বের হয়েছে।

গায়ক, অভিনেতা, উপস্থাপক আবার মডেল হিসেবে দেখা গেলেও তাহসান তাঁর গায়ক সত্তাকেই বেশি গুরুত্ব দেন। তাঁর মতে, ভক্তরা সব থেকে বেশি চেনে, জানে ‘গায়ক’ হিসেবে। এ কারণেই এ জায়গাটাতে কোনো কম্প্রোমাইজ নয়। তাঁর ভাষায়, ‘শ্রোতা বা ভক্তকে বিরক্ত করার কোনো অধিকার আমার নেই। যত দিন ভক্তরা নেবে, নতুন গান, নতুন অ্যালবাম করে যাব।’ তাহসান মনে করেন অ্যালবাম হচ্ছে একজন শিল্পীর স্বাক্ষর। যেখানে একজন কণ্ঠশিল্পীকে পুরোপুরি খুঁজে পাওয়া যায়। ভক্তদের সঙ্গে ভালোবাসা তৈরি হয় অ্যালবাম দিয়েই।

গত বছরগুলোয় ঈদ উৎসবে ছোট পর্দায় যে তাহসান ছিলেন অনিবার্য, সেই তাহসানকে এবার ঈদে কোনো নাটকে দেখা যাবে না। এর একটাই কারণ—একক অ্যালবাম। বর্তমানে এই অ্যালবামে গানের পাশাপাশি তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মাসব্যাপী এ সফরে ছয়টি স্টেটের মঞ্চে গান শোনাবেন। এ তথ্য দিতে দিতে খানিকটা আফসোসও করলেন, ‘অনেক খুঁজে একজন নারী শিল্পী নির্বাচন করতে পারলেন না আয়োজকেরা। এর জন্য শিল্পীরা দায়ী নন। কেননা আমাদের দেশে এখনো গান, টেলিভিশন, সিনেমার বাজারটি শিল্প (ইন্ডাস্ট্রি) হিসেবে গড়ে ওঠেনি। পুরোপুরি পেশাদারি তৈরি হয়নি।’

অথচ এ দেশের দর্শকেরাই হাজার হাজার টাকা খরচ করে অন্য দেশ থেকে আসা শিল্পীর গান শুনতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার মানে এখানে সেই বাজার আছে, দর্শকের সেই চাহিদা আছে। গত ১৫ বছর তিলে তিলে জনপ্রিয় তারকা হওয়া তাহসান স্বপ্ন দেখছেন আগামী ১৫ বছরে বাংলাদেশের সংগীতের অবস্থা সেই জায়গাটায় পৌঁছাবে, যখন আমাদের দেশের একজন শিল্পী অন্য দেশে গেলে তাঁর জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করে টিকিট কেটে দর্শক আসবেন। মিনার, প্রীতম হাসানসহ কয়েকজন শিল্পীর নাম উল্লেখ করে তাহসান বলেন, এখনকার তরুণেরা অনেক যোগ্যতা রাখেন আন্তর্জাতিকভাবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে। তাঁদের সেই মেধা, যোগ্যতা আছে। তবে প্রয়োজন একটু মেনটরিং। যেটার অভাব আমি অনুভব করেছি ক্যারিয়ারে শুরুতে। তাই আমি এখন চেষ্টা করি নবীনদের পাশে দাঁড়াতে, সঙ্গে থাকতে।

বুঝতে বাকি নেই, তাহসানের আগামী স্বপ্নগুলো বেশ বড়সড়। কিন্তু এই যে তাহসানকে ভক্তরা অন্য রকম দেখতে অভ্যস্ত। এককথায়—মার্জিত। সেই তিনি বিচ্ছেদ-সম্পর্কিত খবরের শিরোনাম হলেন। এটা কি ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলবে না? আবারও তাহসানকে আত্মবিশ্বাসী মনে হলো। নিজেই বললেন, ‘মানুষ আমাকে আমার কাজের জন্য ভালোবাসে, ইমেজের জন্য না।’

কাজ নিয়ে এগিয়ে যাবেন তাহসানরা, এটুকু আস্থা রাখতে দোষ আছে কি? অন্তত যিনি স্বপ্নের কথা অকপটে বলতে পারেন, পেছনে না তাঁকিয়ে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা ধরেন।