মেয়ের কণ্ঠে বাবার গান

শাওন মাহমুদ
শাওন মাহমুদ

শাওনের ফোন, কণ্ঠে সংকোচ, ‘আমি না একুশের গানটা করেছি।’

শাওন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গেয়েছে! বাবার গান করেছে মেয়ে! কিছুক্ষণ আমার গলায় কী যেন দলা পাকায়। কথা বলতে পারি না। তারপর বলি, ‘অফিসে গিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলব।’

শাওনকে কাছে পাই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসে। আমরা একসঙ্গে রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধে যাই, মিরপুর যাই, যাই সাভারে। কোনো বছর যদি প্রজন্ম ’৭১-এর কেউ একজন অনুপস্থিত থাকে, ফোনে তার খবর নিই। এই আত্মীয়তার কী নাম হতে পারে, জানা নেই। শাওন না এলে ফোন করি, ও বলে, ‘বাড়িতে থাকতেই ভালো লাগছে আজ।’

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’—মহড়ায় অবসকিউর
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’—মহড়ায় অবসকিউর

তার পরও আমাদের মনে হয়, আমরা কাছে কাছেই থাকি। এই অনুভূতির সঙ্গে একাত্তরের নিবিড় বসবাস।

শহীদ আলতাফ মাহমুদের অসাধারণ সুরে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা যে গান আজ একুশের প্রতীক হয়ে উঠেছে, সেটি তাঁরই (আলতাফ মাহমুদ) মেয়ে শাওন গাইল, এ এক অসাধারণ ঘটনা। মনে হলো, বাবার প্রতি মেয়ের এ এক বিনম্র উপহার।

শাওন তো গান শিখেছে শেখ লুৎফর রহমান আর শিমূল ইউসুফের কাছে। কিন্তু সেভাবে কি ওর গান শুনেছি আমরা কখনো? একুশের গান করে শাওন আমাদের চমকে দিল।

মুঠোফোনে আমার কলটা পেল শাওন। বলল, ‘ভাবছিলাম অনেক দিন ধরেই। ভাবছিলাম, পুরো গানটি করব। সময় আর সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। এবার অবসকিউর-এর সঙ্গে মিলে হয়ে গেল কাজটা।’

ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করি, ‘ভালো গেয়েছ তো?’

হাসে শাওন। বলে, ‘মাকে শোনালাম। মা তো খুব খুশি! আমাকে আর টিপুকে জড়িয়ে ধরেছে।’ আবেগ সামলে রাখতে পারে না মেয়েটা। অবসকিউরের টিপুর সঙ্গেই ঘর বেঁধেছে শাওন।

আমার চোখে ভেসে ওঠে সারা আরা মাহমুদের ক্লান্ত চেহারা! সেই একাত্তর থেকে আলতাফ মাহমুদ নামের মানুষটাকে তো বুকের ভেতর আগলে রেখেছেন। তাঁর ক্লান্তিতে শাওনের গান যেন অনাবিল এক সবুজ ছোঁয়া।

অবসকিউর-এর কি-বোর্ডিস্ট বিনোদ আর লিড গিটারিস্ট রাজিবকে গানটি শোনানোর পর ওরা দুদিন চিন্তা করেছে, কীভাবে গানটি করা যায়। রাজিব তো বলেই বসল, ‘ভাবতেই পারি না! আলতাফ মাহমুদ যে পঞ্চাশের দশকে এ রকম একটা রকিং গান করেছেন। এত আপস অ্যান্ড ডাউন!’

অবসকিউর যেখানে রিহার্সেল করে, সেই ড্রিম ডেস্কে ২০ দিন ধরে গানটার মহড়া করেছিল ওরা।

গানটি কণ্ঠে আর যন্ত্রে ধারণ করা খুব সহজ ছিল না। পুরো গানটি তো চারটি ভাগে ভাগ করা। যেমন প্রথম ছয় পঙিক্ত প্রার্থনার মতো। এর পরের অংশই প্রতিবাদী (জাগো নাগিনীরা জাগো), তারপর দেশপ্রেমে কোমল (সেদিনো এমনি নীল গগনের), এরপর আবার প্রতিবাদ (ওরা এ দেশের নয়)।

শাওনকে জিজ্ঞেস করি, ‘ব্যান্ডের সঙ্গে গানটি করলে, তাতে কোনো...’

শাওন বুঝতে পারে ইঙ্গিতটা। বলে, ‘সুর ও কথা যেন অবিকৃত থাকে, সেটা খেয়াল রেখেছি।’

এরপর শাওন ওর স্বপ্নের কথা জানায়: ‘স্বাধীনতার বীজমন্ত্র’ গানটির মাধ্যমে ব্যান্ড দল অবসকিউর ভিন্ন ধরনের দেশের গান করল। এবার করল একুশের গান। অবসকিউর এ ধরনের গান করে যাবে ভবিষ্যতেও।

দেশ টিভিতে একুশের প্রথম প্রহরে শাওনের কণ্ঠে গানটি শুনতে পাওয়া যাবে।