অমৃতের সন্তানেরা আসছে...

অন্তরালে ইতিহাস নাটকের মহড়ায় ব্যস্ত তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থীদের সংগঠন তেজগাঁও কলেজ থিয়েটারের সদস্যরা। ছবি: খালেদ সরকার
অন্তরালে ইতিহাস নাটকের মহড়ায় ব্যস্ত তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থীদের সংগঠন তেজগাঁও কলেজ থিয়েটারের সদস্যরা। ছবি: খালেদ সরকার

এই তরুণদের সবার পরনে কালো টি–শার্ট আর ট্রাউজার। শুরুটা হলো একটি কোরিওগ্রাফি দিয়ে। সঙ্গে চলছে গানও। কোরিওগ্রাফিতে ফুটে উঠল গোটা বাংলাদেশ। কখনো ঢেউ খেলা নদী, কখনো মুক্তিযুদ্ধ, কখনো উঠে এল শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ।

কোরিওগ্রাফির পরেই শুরু হলো খণ্ড খণ্ড দৃশ্যায়ন। সেখানে কেউ হচ্ছেন বাবা, কেউ মা, কেউ বোন, কেউ পাকিস্তানি সেনা। এই সব কটি দৃশ্য জোড়া দিয়ে তৈরি হলো নাটক অন্তরালে ইতিহাস। এক সন্ধ্যায় ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডের তেজগাঁও কলেজে মহড়া হলো নাটকটির।

এক চিকিৎসকের একটি হাসপাতাল নিয়ে নাটকের কাহিনি। চিকিৎসক ইকরাম চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সন্তানদের বুঝিয়ে দিতে চান হাসপাতালের দায়িত্ব। কিন্তু কে উপযুক্ত এই হাসপাতালের দায়িত্ব নিতে, তা নিয়ে তিনি আলাপ করেন সন্তানদের সঙ্গে। শেষমেশ সিদ্ধান্ত হয়, ছোট মেয়ে নাইমা আক্তারই থাকবেন হাসপাতালের দায়িত্বে। কিন্তু নাইমার কাছে দায়িত্ব দিতে গিয়ে চলে আসে ছোট্ট একটি সমস্যা। নাইমা আক্তার ইকরাম চৌধুরীর মেয়ে নয়। নাইমা তাহলে কার মেয়ে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা চলে নাটকজুড়ে। উত্তর খুঁজতে চলে আসে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটও।

ঢাকায় নাটকের মহড়া চলে নানা জায়গায়। আছে দুই শর বেশি নাট্যদল। ঘটা করে এই তরুণদের নিয়ে আলোচনা কেন? এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোতে নাট্যকলার বিভাগ নেই বললেই চলে। সেদিক থেকে ব্যতিক্রম তেজগাঁও কলেজ। তাদের আছে থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ। সেই সূত্র ধরেই গড়ে উঠেছে তেজগাঁও কলেজ থিয়েটার। এই কলেজের শিক্ষার্থীদের নাট্যদলের প্রথম নাটকের মহড়া এটি।

দলের সব সদস্যই তরুণ। কেউ থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের, কেউ আছেন অন্য বিভাগের। এই নাটকেই পাকিস্তানি সেনার চরিত্রে অভিনয় করছেন ইবনে সাকিব। বললেন, শৈশব থেকেই অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক তাঁর। শিশু একাডেমী থেকে অভিনয়ে পেয়েছেন পুরস্কারও। শিক্ষাজীবনেও তাই থিয়েটারকেই সঙ্গে নিলেন।

সাকিবের মতো অন্য সদস্যরাও তরুণ। সকাল সাড়ে আটটা থেকে ক্লাস চলে কলেজে। তারপর বিকেলের দিকে মহড়ার শুরু। মহড়া করতে করতে সন্ধ্যা পার হয়ে রাত। জিজ্ঞাসা করি, ‘বাবা-মা বকে না?’ সবার মুখে তখন মুচকি হাসি। একজন বললেন, ‘বকে একটু...তবে বুঝিয়ে বললে সব ঠিক হয়ে যায়।’

এখনো অভিনয়কে ভালোভাবে দেখছেন না অভিভাবকেরা। বিভাগের ডেপুটি চেয়ারম্যান জাহারাবী রিপন বলেন, ২০১৪ সাল থেকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে থিয়েটারকে যুক্ত করেছেন তাঁরা। ২০১৬ সালে এসে এটি থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ হিসেবে বিভাগে রূপ নেয়। প্রথম ব্যাচে বেশ ভালো শিক্ষার্থী ছিল। দ্বিতীয় ব্যাচে একটা বিপর্যয় ঘটে। অভিভাবকেরা ব্যাচের সব কটি মেয়েকে নিয়ে যান। অবশ্য তৃতীয় ব্যাচে এসে আবার বেশ কিছু শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন।

তেজগাঁও কলেজে শিক্ষার্থীদের পরিশীলিত বিনোদন ও সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা করতেই এই নাটকের দলের যাত্রা। এই দলের আহ্বান—সুস্থ সংস্কৃতি দিয়েই অভিভাবকদের নাটক নিয়ে ভুল ধারণা ভেঙে দিতে চায়। দলটির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আছেন কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবদুর রশীদ। দলটির দায়িত্বে আছেন জাহারাবী রিপন নিজেই। প্রথম প্রযোজনাটি মঞ্চে আনছেন খুব শিগগির। রোমাঞ্চিত তিনি। দলের সব সদস্যই তরুণ। উচ্ছ্বসিত তাঁরাও। মহড়া হবে আরও কয়েকটি দিন। তারপরেই পাদপ্রদীপের আলোয় আসবেন তরুণ এই অমৃতের সন্তানেরা। সুস্থ সংস্কৃতি নিয়ে ছড়িয়ে পড়বেন গোটা বাংলাদেশে। ঠিক মহড়ার প্রথমে করা তাঁদের কোরিওগ্রাফির গানের কথার মতো—‘আমরা অমৃতের সন্তান, অমরতা আমাদের সঙ্গী। এসো ঈশানে এসো নৈঋতে, এসো এসো উষালোকে এসো হে।’