'দাম বাড়েনি শুধু মঞ্চনাটকের টিকিটের'

মোহাম্মদ আলী হায়দার
মোহাম্মদ আলী হায়দার
>ঢাকার নাটকের দল ‘বটতলা’ ২৭ আগস্ট ১১ বছরে পা রেখেছে। আগামী শনিবার সন্ধ্যা ছয়টায় বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করবে দলটি। এক দশকে দলের কর্মকাণ্ড, নিজেদের নাটক, বদলে যাওয়া মঞ্চনাটকের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বললেন বটতলার শিল্পনির্দেশক মোহাম্মদ আলী হায়দার

বটতলা না রেপার্টরি, না পুরোপুরি প্রথাগত দল। এমন ভিন্নতার পেছনের কারণ কী ছিল?
আমাদের ভাবনা ছিল ‘বটতলা’ হবে একটা উন্মুক্ত জায়গা। যে-কেউ এখানে এসে কাজ করতে পারবে। এখনো অন্য দলের ছেলেমেয়েরা এখানে কাজ করতে আসে। ভালো একজন শিল্পী আমাদের এখানে এসে কাজ করলে আমরা সমৃদ্ধ হই। প্রতিটি দলের আলাদা সংস্কৃতি রয়েছে। প্রতিটি দলের মহড়া, নাটক শুরু করা এবং শেষ করার রীতি ভিন্ন। আমরা সেগুলো থেকেও শিখি। ধরা যাক, নাগরিক বা আরণ্যক দলের কেউ আমাদের সঙ্গে কাজ করতে এসেছে। আলী যাকের ভাই ও মামুনুর রশীদ ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁদের। সেই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করলে আমাদের সুবিধা হয়। এটা একধরনের বিনিময়। আমাদের ইচ্ছে ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নাটকগুলো প্রযোজনা করব। কিন্তু তেমন সাড়া পাইনি।

গত এক দশকে মঞ্চ বদলে গেছে। অনেকে বলেন, এখন নাটকগুলো দর্শককে তেমন টানে না। সমাজের ওপর নাটকের তেমন প্রভাব পড়ছে না।
নাটকের কনটেন্ট যদি দর্শকের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারে, দর্শক যদি সেটাকে নিজের কনটেন্ট মনে করে, সেই নাটকে দর্শকের অভাব হয় না। ঢাকায় এমন ঘটনাও ঘটেছে যে নাটকের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দেড় বছর আমাদের হল দেয়নি। সে সময় মহিলা সমিতির মঞ্চ নতুন করে খুলেছে, সেখানে লোক যায় না। এ রকম পরিস্থিতিতে সেখানে প্রদর্শনী করেছি আমরা। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ‘ক্র্যাচের কর্নেল’ নাটকের ৩৬টি প্রদর্শনীর প্রতিটিই ছিল হাউসফুল। এর কারণ, নাটকটির কনটেন্ট মানুষকে ভাবিয়েছে। আসলে দর্শকই দর্শক আনে। একটি নাটক একজন দর্শকের মনে গেঁথে গেলে তিনিই অন্য আরও কজনকে নিয়ে আসেন। আমাদের ‘খনা’ নাটকের ক্ষেত্রেও সে রকম দেখেছি। একজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, আগের প্রদর্শনীটি তিনি একা দেখেছিলেন। পরে স্ত্রী, ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে এসেছেন। গত ১০ বছরে শিল্পকলায় লম্বা লাইন ধরে নাটকের টিকিট কিনতে দেখা গেছে। টিকিট কেনাকে কেন্দ্র করে মারামারিও হয়েছে। টিকিট না পেয়ে দর্শক চিৎকার-চেঁচামেচি করেছে, হাহুতাশ করেছে। তবে কথা হচ্ছে, শিল্পকলায় প্রতিদিন চারটি নাটক হয়। চারটি নাটকই ভালো করার ক্ষমতা আমাদের নেই। যেগুলো ভালো হয়, সেগুলোয় ঠিকই দর্শক হয়।

ঢাকায় অনেক দল। নাটকের মানুষ হিসেবে গড়ে মূল্যায়ন করতে বললে সেই দলগুলোর নাটক নিয়ে কী বলবেন?
প্রতিদিনই নতুন নতুন দর্শক তৈরি হচ্ছে। আমরা একসময় মহাভারতের কনটেন্ট নিয়ে কাজ করেছি। মাঝে বিদেশি নাটক নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এখন নতুন নতুন সব এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। নির্দেশকেরা সব রকম ফরমকে ভাঙার চেষ্টা করছেন, নতুন ফরম তৈরির চেষ্টা করছেন। গল্পকে ভিন্নভাবে বলা যায় কি না, সেই চেষ্টা করছেন। নন-লিনিয়ার নাটক আগে প্রায় দেখাই যেত না, এখন অনেক হচ্ছে। সব মিলিয়ে অনেক নতুন কাজ হচ্ছে। তবে মঞ্চের খুব বেশি প্রচার নেই। আরও একটি সংকট হচ্ছে, টিকিটের কম দাম। গত ১০ বছরে সবকিছুর দাম বেড়েছে, শুধু মঞ্চের টিকিটের দাম বাড়েনি। সিনেমা দেখলে ৩০০ টাকা খরচ হয়, আর মঞ্চের টিকিটের দাম এখনো ১০০ টাকাই রয়ে গেছে। টিকিটের দাম বাড়াতে হবে। মঞ্চে অনেক কারিগরি ব্যাপার আছে। এখন নতুন অনেক লাইট এসেছে, সেগুলো খরচসাপেক্ষ। ইফেক্ট মেশিন ভাড়া করতে হয়, যা অনেক মিলনায়তনে থাকে না। অনেক সময় মাল্টি-প্রজেক্টর নিয়ে কাজ করতে হয়। এসব একটা ব্যাপক খরচের ব্যাপার। কিছু দল আছে, তাঁদের নাটকে হয়তো কোনো সেট নেই। পুরোনো দিনের মতো অভিনেতা একা মঞ্চে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলছেন। সেখানেও অভিনয়ের অনেক সুযোগ রয়েছে। অনেকে আবার বিশাল সেট নিয়ে কাজ করে।

মোহাম্মদ আলী হায়দার
মোহাম্মদ আলী হায়দার

এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে কি ইউটিউব-নেটফ্লিক্স দেখা দর্শক টানা যাবে?
মঞ্চ সবচেয়ে প্রাচীন মাধ্যমগুলোর একটি। টেলিভিশন এসেছে, সিনেমা এসেছে, তাতে মঞ্চের প্রয়োজন কমেনি। কিছু দর্শক আছেন, যাঁরা জীবন্ত চরিত্রের স্বাদ নিতে চান, লাইভ চরিত্রের সঙ্গে ইন্টারেকশন করতে চান। নানা কারণে হয়তো আমাদের দেশে সে রকম দর্শক বাড়ছে না।

মঞ্চ একটা প্রতিবাদের ক্ষেত্র। শুনেছি, একবার প্রতিবাদ করে শিল্পকলায় দেড় বছর জায়গা পাননি। আবারও প্রতিবাদ করতে সাহস করবেন?
শিল্পী হিসেবে আমার একটা ভিন্নমত থাকতে পারে। যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আমার মনে হতে পারে যে এতে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সেটার বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই কথা বলব। সেটাই শিল্পীর কাজ। যদিও এখন একটা ‘চুপ’ থাকার সময় যাচ্ছে। কিন্তু আমরা বটতলা কথা বলতে চেষ্টা করি। কথা বলাটা জরুরি। সুন্দরবনের রামপালে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়া-না হওয়া প্রসঙ্গে একটি দল নাটকের আগে ‘বাহাস’ নামে একটি আলোচনার আয়োজন করতে চেয়েছিল। তাঁদের হল দেওয়া হয়নি। এখনো তাঁদের হল দেওয়া হচ্ছে না। আমরা এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলাম, সে জন্য আমাদেরও ১৮ মাস হল দেওয়া হয়নি। এখনো যে আমরা সব জায়গায় সব সুযোগ পাচ্ছি, তা নয়। এখনো অনেক বাধাবিঘ্ন রয়েছে আমাদের সামনে। বিদেশে রাষ্ট্রীয় সফরগুলোতে ডাক পাই না, জাতীয় নাট্য উৎসবে ডাক পাই না। কিন্তু আমরা থেমে নেই। নিজেরাই আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসব করি। এসব নিয়ে খুব বেশি হতাশ নই। আমরা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্য হইনি। দল গঠনের সময়েই সিদ্ধান্ত ছিল সেটা। ফেডারেশনের সঙ্গে থাকলে যতটা উৎসাহ পাওয়ার কথা, মনে হয়েছিল তাঁদের কাছ থেকে সেটা পাওয়া যায় না। সেটাও আমাদের একধরনের প্রতিবাদ।

র‍্যাংগস ভবন দুর্ঘটনায় নিহত রুহুল আমিনের লাশ সাত দিন পড়ে ছিল। ঘটনাটি আপনাদের নাড়া দিয়েছিল। সেটা নিয়ে আপনাদের নাটক ‘একজন রুহুল আমিন’। এর থেকেও ভয়াবহ সব ঘটনা গত ১০ বছরে ঘটেছে। সেসব নিয়ে নাটক করলেন না কেন?
সেটা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। সেটাও ছিল একটা ‘চুপ’ থাকার সময়। কিছু বললেই ধরে নিয়ে যেত। তখনো আমরা নাটক করেছি। এখনো করেছি। ‘ক্র্যাচের কর্নেল’ সে রকম একটি কাজ। সুন্দরবন ইস্যুতে করেছি ‘মধুশিকারি’ ও ‘সুন্দরবন কথা’। টিএসসিতে নারী নিগ্রহ নিয়ে করেছি ‘আর চুপ থাকা নয়’। বটতলা সব সময় মাঠে ছিল। আমাদের দলে জামায়াত ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক আছে। ডান, বাম সব ঘরানার লোক আছে। তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। এই সরকারের নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও যতটা কথা বলা দরকার, আমরা বলেছি। ‘ক্র্যাচের কর্নেল’ যে দেখেছেন, সে-ই বলেছে, ‘তোমাদের এত সাহস।’ আসলে সাহস নয়, এটা শিল্পীর অনুভূতি।

মঞ্চের লোক আপনি। টেলিভিশনে কাজ করতে দমবন্ধ লাগে?
ঠিক মঞ্চের না, আমি টেলিভিশনেরই লোক। একসময় একুশে টেলিভিশনের প্রযোজক ছিলাম, এখন দুরন্ত টিভির হেড অব প্রোগ্রাম। ‘সিসিমপুর’-এর প্রযোজক ছিলাম আট বছর। টেলিভিশন আমার পেশা। এটা আমার ভালোবাসা। মঞ্চও আমার ভালোবাসা। টেলিভিশনে কাজ করে আমার জীবন চলে, মঞ্চে কাজ করে আমার মনের জীবন চলে।