সারা জীবন মা আমাদের বাচ্চাই মনে করতেন

ফিরোজা বেগম
ফিরোজা বেগম
নজরুলসংগীতের সুর-তাপসী ফিরোজা বেগম। ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংগীত সাধনায় সক্রিয় ছিলেন। যাঁরাই তাঁর কাছে গেছেন, তাঁর ব্যক্তিত্বের বিভায় মুগ্ধ হয়েছেন। যেমন কণ্ঠ ছিল, মানুষ হিসেবেও ছিলেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বময়। ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর চিরবিদায় নেন ফিরোজা বেগম। সংগীতজীবনের মতো পারবারিকজীবনেও ছিলেন সচেতন। মৃত্যুবার্ষিকী সামনে রেখে তাঁকে স্মরণ করেছেন বড় ছেলে বিশিষ্ট ব্যান্ড সংগীতশিল্পী হামিন আহমেদ। প্রথম আলোর কাছে মায়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে প্রথমেই একটু আক্ষেপ করলেন। পারিবারিকভাবে তাঁকে স্মরণ করা হলেও রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ থাকে না। শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি থাকে নীরব! গ্রন্থনা করেছেন মাসুম আলী


প্রায় ৪ বছর হয়ে যাচ্ছে। মা নেই। মাকে হারিয়ে এখন আমরা খুব অসহায়বোধ করছি। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সম্পদটি আমরা হারিয়েছি।

আমরা খুব অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। তবে বাবার অনুপস্থিতি মা খুব একটা অনুভব করতে দেননি। অবাক করা বিষয় যে এত সফল একটা ক্যারিয়ারের পাশাপাশি উনি সুন্দরভাবে সংসারও সামলেছেন। ছোটবেলা থেকে তাঁর স্বাস্থ্যসম্মত খাবার আমাদের প্রিয়। সন্তান হিসেবে আমরা কখনো অবহেলা পাইনি। আমি দেখেছি, গান গেয়ে স্টুডিও থেকে ঘরে ফিরেই রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছেন, নামাজ পড়ছেন, আমাদের যত্নআত্তি করছেন। তাঁর এত ব্যস্ততার মধ্যেও কখনো আমাদের মায়ের অভাব বোধ করতে দেননি।

সারা জীবন মা আমাদের বাচ্চাই মনে করতেন। বাইরে কোথাও যখন আমরা যেতাম, বলতেন, এটা করবি না, ওটা করবি না—যেন বাচ্চা ছেলে আমরা। আমরা যখন বড় হয়েছি, তখনো মা যেন কেমন বাচ্চাই মনে করতেন আমাদের, আগলে রাখার চেষ্টা করতেন। এমনকি বড় হওয়ার পরও পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে খাওয়া, সবাই মিলে বসে গল্প করা মা খুব পছন্দ করতেন। খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিল খুব। একসঙ্গে টেলিভিশন দেখা, গানের অনুষ্ঠান দেখা—এ সবই মনে পড়ে। হাসপাতালে থাকার সময়টাতেও তিনি গান শুনেছেন, গান নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

মা আমাদের কখনো সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে বাধা দেননি। নিজের মতামত চাপিয়ে দেননি। কিছু বলেনওনি। স্বাধীনভাবে যেটা ইচ্ছা সেটা করছিলাম। চলতে চলতে এ ব্যাপারে মায়ের উদারতা টের পেয়েছি। উনি জানতেন যে সংগীত এমন একটা ব্যাপার যা ধরে-বেঁধে করানো যায় না। তিনি মনে করতেন, যত ধরনের গানবাজনা করা হবে, তত চর্চা হবে, জানাশোনা বাড়বে। শেষদিন পর্যন্ত মা আমাদের ভালো কাজগুলোকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। আর বাজে কোনো কাজ খুব স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতেন যে তিনি তা পছন্দ করেননি।

৪০-এর দশক থেকে নজরুলসংগীত রেকর্ড হয়ে আসলেও পরিচিতিটা আমার মায়ের মাধ্যমেই। মানুষের কাছে নজরুলের গান গ্রহণযোগ্য করে তোলার পেছনে তাঁর অবদান অনেক। আমার মনে হয় যে নজরুল সংগীতকে তিনি ভিন্ন একটি পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। সেটা কণ্ঠ দিয়ে হোক, আর পরিবেশনার বৈচিত্র্য দিয়েই হোক, ফিরোজা বেগম একক, অনন্য ও অদ্বিতীয়া।