টিভি নাটকের মূল সমস্যা এখন গল্প

একজন সঙ্গে ছিল নাটকে অভিনয় করেছেন সজল ও অপর্ণা
একজন সঙ্গে ছিল নাটকে অভিনয় করেছেন সজল ও অপর্ণা

ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা শেষে টিভি চ্যানেলগুলো আবার ফিরে এসেছে তাদের নিজস্ব রুটিনে। আরটিভির সাপ্তাহিক নাটক প্রচারিত হয় প্রতি শুক্রবার রাত ৮টায়। ৩১ আগস্ট সজীব খানের রচনা ও পরিচালনায় প্রচারিত হলো নাটক একজন সঙ্গে ছিল। অভিনয় করেছেন অপর্ণা, সজল প্রমুখ। শুরুতেই দেখানো হয়, অপর্ণা আবিদ নামে একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে। নিয়মিত ডেটিং করছে। মাঝখানে হঠাৎ তার বাবার বন্ধুর ছেলে পরিচয়ে সজলের আবির্ভাব। সজল বলে দিল আবিদ দুর্ঘটনায় মারা গেছে আরও দুই বছর আগে। আবিদের সঙ্গে প্রেম ও অভিসার আসলে অপর্ণার মিথ্যে কল্পনা। ব্যস, এরপর আর অপর্ণার প্রেম নেই, অভিসার নেই, সে লক্ষ্মী ঘরোয়া মেয়ে হয়ে গেল।

এককথায় বলব, অস্বাভাবিক গল্প। শুধু অস্বাভাবিকই নয়, অবাস্তবও বটে। আবিদের সঙ্গে অপর্ণার প্রেম নির্মাতা যেভাবে দেখিয়েছেন, তা একবারও মনে হয়নি কল্পনা। এ ছাড়া মা ও বোনের সঙ্গে তার তেমন কোনো সম্পর্কই দেখানো হয়নি। আর অপর্ণার মিথ্যে প্রেমের এ অভিসার মা–বোন কেউ বুঝল না, সজল চট্টগ্রাম থেকে এসে বুঝে ফেলল? বিষয়টি একেবারেই অস্বাভাবিক হয়েছে। আর নাটকে সজলের চরিত্রায়ণ যেমন হয়েছে বেখাপ্পা, অভিনয়ও হয়েছে ততোধিক বেমানান।

একই দিন একুশে টিভিতে রাত ১০টায় প্রচারিত হলো এ সপ্তাহের নাটক তাই তোমার গল্পে। রচনা গোলাম সরোয়ার অনিম, পরিচালনা মেহেদি হাসান জনি ও অভিনয়ে অপূর্ব, শারলিন ফারজানা, মম আলী, মৌরিতা, জুঁই প্রমুখ। নাটকের গল্পে দেখা যায়, রিহানের প্রেমিকা মাত্রা একদিন হঠাৎ আঙুলে বাগদানের আংটি পরে এসে রিহানকে দেখিয়ে বলে, তার অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তারপর সত্যিই বিয়ে হলো। মাত্রা কানাডা চলে গেল। আবার ডিভোর্স হয়ে দেশে ফিরে এল, তারপর বিধবা বেশে রিহানের সঙ্গে মাত্রার বিয়ে হয়ে গেল। এই হলো গল্প।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন মাত্রার অন্যত্র বিয়ে হলো, কেন মাত্রা তা মেনে নিল, কেন কানাডা গেল, কেন ডিভোর্স হলো এবং ফিরে এল। নাটকের গল্পে এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই, সম্ভাব্য সমাধানও নেই, আশ্চর্য। আবার বিয়ের অনুষ্ঠানের কোনো খবর নেই, অথচ মাত্রা হলুদের অনুষ্ঠানে কার্ড দিয়ে দাওয়াত করেছে রিহানকে। হলুদের সে অনুষ্ঠানে আবার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, উৎসবের কোনো নিশানা নেই, শুধু নামমাত্র দুজন বন্ধু দারোয়ানের মতো দাঁড়িয়ে আছে, বাস্তবতার বিন্দুমাত্র লেশ নেই। এই হলো নাটক। পরপর প্রচারিত দুটি নাটকের সৃজন ও নির্মাণ দেখে মনে হয়েছে, আমাদের বর্তমান টিভি নাটকের মূল সমস্যাটাই হলো গল্প। গল্পের কোনো বাস্তবতা নেই, বিশ্বস্ততা নেই, চরিত্রায়ণেও রয়েছে ব্যাপক দুর্বলতা।

এবারের আলোচনা সরাসরি প্রচারিত দুটি গানের অনুষ্ঠান। প্রথমটি প্রচারিত হলো ৩০ আগস্ট রাত ১১টা ১৫ মিনিটে আরটিভিতে। নাম মিউজিক স্টেশন। শিল্পী ছিলেন এ সময়ের প্রতিভাবান তিন শিল্পী কর্নিয়া, সজল ও ঐশী। অনুষ্ঠানটি ভালো লেগেছে এ জন্য যে তিনজনের কণ্ঠ ও পরিবেশনার মাঝে সুস্পষ্ট তিনটি বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। তিনজন গান করেছেন পালাক্রমে। কর্নিয়ার উল্লেখযোগ্য পরিবেশনার মাঝে ছিল ‘ভালোবাসায় শুধু প্রহর গুণে যাই’, ‘হতে পারিস তো বন্ধু আমার’ ইত্যাদি। কর্নিয়ার অধিকাংশ গানই ছিল উঁচু পর্দায়। কণ্ঠ সুরেলা, তবে যখন উঁচুতে যায়, তখন কিছুটা কর্কশ মনে হয়। আর শ্রোতা হিসেবে সবচেয়ে বড় যে সমস্যা অনুভব করছিলাম তা হলো, তাঁর গানের বাণীর অস্পষ্টতা। যে কারণে শ্রোতাদের কাছে তাঁর গান মনে হচ্ছিল বাণীহারা সুরের ঝংকার।

উঁচু পর্দায় গান করেছেন ঐশীও। কিন্তু ঐশীর গানের বাণীতে অস্পষ্টতা ছিল না। পরিবেশনাও ছিল বৈচিত্র্যময়। তিনি লালনের গান করেছেন, সিনেমার গান করেছেন আবার ব্যান্ডের গানও করেছেন। সুরের সঙ্গে তাঁর কণ্ঠ এবং শরীর দুই–ই যেন সংগত করে। তাঁর পরিবেশনার এ বৈশিষ্ট্য সত্যিই ব্যতিক্রম এবং একান্তই তাঁর নিজস্ব। তাঁর উল্লেখযোগ্য পরিবেশনার মধ্যে ছিল লালনের ‘কোথায় রবে হে ভাই বন্ধু’ ‘চলচ্চিত্রের গান’ ‘জীবন খোঁজে জীবন’ ইত্যাদি।

অন্যদিকে সজলের পরিবেশনাও ছিল আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাঁর কণ্ঠ যেন সুরের মাঝে ভেঙে ভেঙে যায়, কেঁপে কেঁপে যায়। মাঝে মাঝে জেমসের মতো মনে হলেও প্রকৃত বিচারে বোঝা যায়, তাঁর বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্র। তিনি প্রায় সব গানেই সুরের উঁচু ও নিচু পর্দায় বিচরণ করেছেন। উঁচুর চেয়ে নিচু পর্দায় তাঁর কণ্ঠ অধিক সাবলীল মনে হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য পরিবেশনার মধ্যে ছিল ‘ফেরারি এ মনটা আমার’, ‘যদি কখনো ভুল হয়ে যায়’ ইত্যাদি।

৩১ আগস্ট বেলা ২টা ৩০ মিনিটে মাছরাঙা টিভিতে সরাসরি প্রচারিত হলো তাদের নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘ইচ্ছে গানের দুপুর’। দিঠি আনোয়ারের উপস্থাপনায় এবার উপস্থিত ছিলেন শিল্পীদম্পতি নবনীতা চৌধুরী ও লাবিব কামাল গৌরব। দুজনের প্রায় সব পরিবেশনাই ছিল লোকসংগীত।

শিল্পী নবনীতা মূলত টিভি উপস্থাপক। কিন্তু তিনি যে এত সুন্দর গানও করেন, তা যেন শ্রোতাদের অজানাই। তাঁর উল্লেখযোগ্য পরিবেশনার মধ্যে ছিল হাসন রাজার ‘আহা রে সোনালি বন্ধু রে’, রাধারমণের ‘বলো গো বলো গে সখী কোন বা দ্যাশে যাই’, রবীন্দ্রসংগীত ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ ইত্যাদি। তাঁর বৈশিষ্ট্যের কথা যদি বলি, উপস্থাপনা খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল। কণ্ঠ সুরেলা হলেও মিষ্টতার কিছু অভাব মনে হয়েছে। বিশেষ করে স্বরগ্রামের নিচের দিকে। আর লোকসংগীতের চেয়ে রবীন্দ্রসংগীতেই মনে হয়েছে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল।

অন্যদিকে শিল্পী লাবিবের উল্লেখযোগ্য পরিবেশনার মধ্যে ছিল ‘লোহা রে বানাইলা কাঞ্চা সোনা’, ‘দিল দরিয়ার মাঝে আছে মজার কারখানা’, ‘আমার মনের মানুষ চিনলাম না রে’ ইত্যাদি। তাঁর কণ্ঠ সুরেলা ও মার্জিত। উপস্থাপনার মাঝে আধুনিকতার ছাপ এবং পরিমার্জন ও পরিশীলনের ছাপ লক্ষণীয়। দু-একটি গানে কিছু কিছু শব্দ–উচ্চারণ অস্পষ্ট মনে হয়েছে এবং লোকসংগীতের অকৃত্রিম সরলতা অনুপস্থিত মনে হয়েছে। এটি না হলে হয়তো আরও ভালো লাগত।