'আজ যে ফ্রি দেখেছে, কাল সে টিকিট কেটে দেখবে'

জাতীয় নাট্যশালায় আইডিএলসি নাট্যোৎসবের সমাপনী দিন সম্মাননা দেওয়া হয় নাট্য দম্পতিদের
জাতীয় নাট্যশালায় আইডিএলসি নাট্যোৎসবের সমাপনী দিন সম্মাননা দেওয়া হয় নাট্য দম্পতিদের

ছিমছাম গোছানো আয়োজন। দর্শক এসেছেন। মন ভরে নাটক দেখেছেন। কেউ কেউ এক সন্ধ্যায় দুটি নাটকও উপভোগ করেছেন। পরিপাটি সাজানো নাট্যশালা করিডরে ছিল নাটকের পোস্টার, কস্টিউম নিয়ে প্রদর্শনী। সেখানেও সাগ্রহ নিয়ে দর্শক ভিড় করেছেন, কেউ কেউ নিজের মুঠোফোনের ক্যামেরায় নিজেকে রেখে ধারণ করেছেন এই দৃশ্য। সব মিলে শীতের আমেজে ভাদ্র মাসেই পাঁচ দিন নাটকের উৎসব হয়ে গেল জাতীয় নাট্যশালায়।

সারা বছরই নাট্যকর্মী তথা সংস্কৃতিসেবীরা বলে আসছেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ বাজেট যথাযথ না, ‘অপ্রতুল’। মঞ্চনাটকের মান বৃদ্ধির জন্য থোক বরাদ্দের দাবির কথাও শোনা যায়। আবার দর্শকস্বল্পতার কথাও বলেন কেউ কেউ। এমন অবস্থায় ব্যতিক্রমী নাট্যোৎসবের আয়োজন করল আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড।

‘নাট্যমঞ্চ হোক আনন্দ উৎস’ স্লোগান সামনে রেখে ৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার শুরু হয়েছিল উৎসব। চলে ৮ সেপ্টেম্বর, শনিবার পর্যন্ত। অনলাইন থেকে বিনা মূল্যে নাটকের টিকিট সংগ্রহ করে পাঁচ দিনের এ উৎসবে দর্শক দেখলেন প্রাঙ্গণেমোরের হাছনজানের রাজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের দ্য লোয়ার ডেপথ্স, ঢাকা পদাতিকের ট্রায়াল অব সূর্যসেন, পালাকারের বাংলার মাটি বাংলার জল, বটতলার ক্র্যচের কর্নেল, ঢাকা থিয়েটারের পঞ্চনারী আখ্যান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের দ্য আলকেমিস্ট, থিয়েটারের মুক্তি, প্রাচ্যনাটের সার্কাস সার্কাস ও নাগরিকের ওপেন কাপল। প্রতিদিনই উল্লেখ করার মতো দর্শকের উপস্থিতি ছিল নাটকের প্রদর্শনীগুলোতে।

সারা বছরই নাট্যকর্মীদের সঙ্গে দর্শকের কমবেশি যোগাযোগ থাকে। কর্মীরা সারা বছরই নাটকের চর্চা করে যান, মঞ্চে নাটক পরিবেশন করেন। তবে উৎসবটা মূলত জমে শীতে। এদিক থেকে এই সময়ে আইডিসিএলের উৎসবটি ব্যতিক্রম। আর এই উৎসব উদ্বোধনের দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত আলোচনায় ছিল।

উদ্বোধনী সন্ধ্যার কথাই বলি। সেদিন উৎসবের উদ্বোধন করতে এসে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের বক্তব্য আয়োজকদের দারুণ অনুপ্রাণিত করে। মঞ্চ নাটক চর্চা ব্যয়বহুল শিল্পমাধ্যম মন্তব্য করে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে মঞ্চ নাটক থেকে আয় করে শিল্পী তথা নাট্যকর্মীর জীবিকা নির্বাহ তুলনামূলকভাবে কঠিন। সে জন্য দেশের ব্যবসায়িক বা আর্থিক কোনো প্রতিষ্ঠান নাটকের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এলে নাট্যকর্মীদের উচিত, সেই সুযোগ গ্রহণ করা। সেটি নাটকের জন্য ভালো হবে। নাটক এগিয়ে যাবে এবং সমৃদ্ধ হবে।’ তিনি নাট্যকর্মীদের যাঁদের জীবন-জীবিকা মূলত নাটকের ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের বাছাই করে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রাতিষ্ঠানিক-সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বার্ষিক সম্মানীর ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন।

উৎসবে মঞ্চস্থ হয়েছে সার্কাস সার্কাস নাটকটি
উৎসবে মঞ্চস্থ হয়েছে সার্কাস সার্কাস নাটকটি

উৎসবের সবচেয়ে বড় আয়োজনটি হয় শেষ দিন। সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এই অনুষ্ঠানে মঞ্চনাট্য আন্দোলনে ভূমিকা রাখার জন্য আইডিএলসির উদ্যোগে চার দম্পতিকে নাট্যজন সম্মাননা পদক প্রদান করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এদিন জাতীয় নাট্যশালার সুপরিসর মঞ্চটি যেন ধন্য হয় দেশের উজ্জ্বল নাট্য দম্পতিদের পদচারণে। সম্মাননা পেয়েছেন সারা যাকের ও আলী যাকের, ফেরদৌসী মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদার, লাকী ইনাম ও ইনামুল হক এবং শিমূল ইউসুফ ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তবে নাসির উদ্দীন ইউসুফ দেশের বাইরে থাকায় এবং শিমূল ইউসুফ অসুস্থ থাকায় তাঁদের পক্ষ থেকে তাঁদের মেয়ে এশা ইউসুফ সম্মাননা পদক গ্রহণ করেন।

প্রতিদিনই বিনা মূল্যে দর্শক নাটক দেখেছেন। নাটকের মতো শ্রমসাধ্য মাধ্যমকে এভাবে বিনা মূল্যে প্রদর্শনীর ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন তরুণ নাট্যকর্মীরা। অনেকে এর তীব্র নিন্দাও জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক লেখালেখি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নাট্যব্যক্তিত্ব তারিক আনাম খান বলেন, ‘পৃষ্ঠপোষকতা অবশ্যই জরুরি, এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু আমি বিনয়ের সঙ্গেই বলছি, ফ্রি নাটক দেখার বিষয়টাকে মোটেও সমর্থন করতে পারলাম না। আয়োজনটি যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে হতো, তাহলে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারে এমনটি সমর্থনযোগ্য না। কেননা দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চা গ্রুপ থিয়েটারের অনেক বছরের আন্দোলনের ফসল।’ তিনি আরও বলেন, ‘টিকিট কেটে যখন একজন নাটক দেখে, তখন তার মধ্যে একটা দায়িত্ববোধের জন্ম হয়। বিনা মূল্যে হলে ঢুকে গেলে সে দায়িত্ববোধ থাকার কথা না।’

 এ প্রসঙ্গে ভিন্নমত দিলেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) সাম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার। নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এখানে এমন অনেক দর্শক দেখেছি, যারা আগে কখনো নাটক দেখতে আসেনি। এই নতুন দর্শকটির যদি নাটকের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়, তাতে তা আমাদের জন্যই ভালো। নাটকপাড়ায় আসার অভ্যাস তো হলো। আজ যে ফ্রি দেখেছে, কাল সে টিকিট কেটে দেখবে।’

মঞ্চনাটকের প্রতি তরুণদের সম্পৃক্ততা বাড়াতেই ‘বিনা মূল্যে নাটক উপভোগের আয়োজন’ বলে জানিয়েছেন উৎসবের আয়োজক আইডিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান। তাঁর আশা, এই আয়োজন নিঃসন্দেহে মঞ্চনাটকের প্রতি তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে এবং এ দেশের মঞ্চনাটকে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের আরও অনুপ্রাণিত করবে। নাটকের মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রতিবছর এ ধরনের উৎসব করার ইচ্ছা আছে বলে জানালেন তিনি।