অভিনয়টাকে আমরা উপাসনার মতো নিই: আলী যাকের

গ্যালিলিও নাটকে আলী যাকের। ছবি: প্রথম আলো
গ্যালিলিও নাটকে আলী যাকের। ছবি: প্রথম আলো
গঙ্গা–যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবে ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটারে দেখানো হবে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নাটক ‘গ্যালিলিও’। ২০ বছর পর নাটকটি আবার করছে নাগরিক। একটি প্রদর্শনীও হয়ে গেছে এরই মধ্যে। মঞ্চের খ্যাতিমান অভিনেতা আলী যাকের এ নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন। নাটকটি নিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে।


৪৪ বছর বয়সে ‘গ্যালিলিও’তে প্রথম অভিনয় করেছিলেন। তখন নাটকের গ্যালিলিওর বয়সের চেয়ে আপনি ছিলেন তুলনামূলক তরুণ। আর এখন আপনার বয়স নাটকের গ্যালিলিওর চেয়েও বেশি। দুই রকম বয়সে অভিনয়ে কি পরিবর্তন আনতে হয়েছে?

নাটকে ৪৬ বছর বয়সে গ্যালিলিওর শুরু, সত্তরোর্ধ্ব বয়সে শেষ। লক্ষ করে থাকবেন, মঞ্চে কিন্তু সে অনুযায়ীই বয়স বাড়াতে হয়েছে। পোশাকের ক্ষেত্রেও সেই পরিবর্তন লক্ষ করে থাকবেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পোশাক সাদা হতে শুরু করে। এই ডিজাইনটাই আমি মেনে চলেছিলাম আগের মঞ্চায়নগুলোতেও, এবারেরটাও ব্যতিক্রম নয়। এমন না যে আমার বয়স বেড়েছে বলে এবার মঞ্চে আমার চলাফেরা কমে গেছে, ব্যাপারটা এমন না। গ্যালিলিও এমনই ছিল, সব সময়ই। এই বয়স বেড়েছে চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গেই।
আর আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, এখনকার মঞ্চনাটকের ইন্টারপ্রিটেশন হলো অনেকটা অ্যাক্রোবেটিক (শরীরী কসরতের)। আমি অ্যাক্রোবেটিকে বিশ্বাসী নই। আমি সার্কাসের বেলায় অ্যাক্রোবেটিকে বিশ্বাস করি, অভিনয়ের বেলায় নয়। আমি পুরোনো ঘরানার মানুষ। লরেন্স অলিভিয়ের, জন গিলগুড, পিটার ও’টুল যা করতেন—অভিনয়ে চরিত্রের ভেতরে ঢোকা, চরিত্রের চিত্রায়নে জোর দেওয়া—আমিও সেটাই করি।

আপনি ও আসাদুজ্জামান নূর তো অনেক বড় অভিনেতা। আগেও ‘গ্যালিলিও’ একসঙ্গে করেছেন। নতুন যাঁরা এতে কাজ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াটা এত অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে করলেন?
আমি আমাদের নাট্যদল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের তরুণ শিল্পীদের নিয়ে গর্বিত। নাগরিকের মূল্যবোধগুলো সনাতন মূল্যবোধ। অভিনয়টাকে আমরা উপাসনার মতো নিই। যেকোনো নাটকের শুরুতে আমরা পর্দা টেনে দিয়ে এক মিনিট মঞ্চে ধ্যান করি। এই ধ্যান করান পান্থ শাহরিয়ার। তিনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু মঞ্চে তিনি যেভাবে ধ্যান করতে বলেন, আমরা সেভাবেই ধ্যান করি। নাগরিকের জন্য উচ্চারণ খুবই জরুরি। আমি যখন ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ করেছি, চেষ্টা করেছি রংপুরের ভাষাটা সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করতে। যখন ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ করি, তখন পুরোপুরি যশোরের ভাষায় কথা বলি, যখন ‘কাঁঠালবাগান’ করি, তখন আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষা বলি। কিন্তু যখন ‘গ্যালিলিও’ করি, তখন একদম প্রমিত বাংলায় সংলাপ বলি। এই জিনিসটা আমাদের (নাগরিকের) প্রত্যেক শিল্পীকেই শেখানো হয়েছে। আমাদের এখানে যারা আসে, তাদের ছয় মাসের মধ্যে ভাষাটা শিখতে হয়।
এরপর আসে পাংচুয়েশন। কোন সংলাপে কোথায় যতি পড়বে, তা লক্ষ রাখি। আমরা এগুলো শেখানোর সংস্কৃতিটা এখনো মেনে চলি। এ জন্য অনেকেই একসময় আমাদের ‘সাহেব গ্রুপ’ বলত। হা হা হা।’

গত কয়েক বছরে আপনাকে দারুণ শারীরিক ও মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এরপর যে উঠে আসাটা, সেটা নিয়ে একটু বলুন—
থিয়েটার এবং নাগরিক যৌথ প্রযোজনায় আমরা ‘ম্যাকবেথ’ নাটক নিয়ে একবার গিয়েছিলাম কলকাতায়। কলকাতার রবীন্দ্রসদনে হবে মঞ্চায়ন। আমি আর ফেরদৌসী মজুমদার মেকআপ নিচ্ছিলাম সাজঘরে। সেখানে খোকনদা (রুদ্র প্রসাদ সেন) ঢুকলেন দ্রুত। ঢুকে একটি চৌকি পেতে বালিশ–তোশক বিছালেন। আমরা বললাম, কী ব্যাপার খোকনদা, কে আসছেন? তিনি বললেন, ‘ছোটলু, শম্ভুদা (শম্ভু মিত্র) একটু বসবেন। তাঁর তো ৭০ হলো, বেশিক্ষণ চেয়ারে বসতে পারেন না। কিছুক্ষণ এলিয়ে বসবেন। তোমাদের কোনো অসুবিধা নেই তো?’ আমরা বললাম, বলেন কী? শম্ভুদা বসবেন এতে আমরা কৃতার্থ! গ্যালিলিওর মেকআপ নিচ্ছিলাম আর হাসছিলাম এ কথা মনে করে। পান্থ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি হাসছেন কেন একা একা?’ বললাম, হঠাৎ মনে পড়ল গল্পটা। আমি ৭৪ হলাম, ক্যানসার থেকে উঠলাম, দিব্যি চলে যাচ্ছি কিন্তু...।