ক্যানসারকে কৃতজ্ঞতা মনীষার!

বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে কথা বলেছেন মনীষা কৈরালা। ছবি : মাসুম অালী
বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে কথা বলেছেন মনীষা কৈরালা। ছবি : মাসুম অালী

শিরোনাম দেখে অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন ভুল করে কিংবা অভিমানের সুরেই বলেছেন বলিউড তারকা মনীষা কৈরালা? একদমই তা নয় । শনিবার দুপুরে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনের মঞ্চে বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন ‘নাইন্টিন ফোরটি টু আ লাভ স্টোরি’ ছবির মনীষা কৈরালা। স্নিগ্ধ হলুদ শাড়িতে সমুজ্জ্বল মনীষা বলেন, ‘আমি মনে করি, আমাদের জীবনে যেকোনো পরিস্থিতি কোনো না –কোনো শিক্ষা দেয়। বিশ্বাস করুন,আমি ক্যানসারের প্রতি কৃতজ্ঞ, ক্যানসার আমাকে জীবনের মূল্য শিখিয়েছে। যুদ্ধ করতে শিখিয়েছে। মরণের জন্য আমি কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না।’
স্মিত হেসে কিছু কঠিন বাস্তবতার কথা বললেন নেপালি মেয়ে মনীষা। হাসিমুখে বললেন, ‘অনেক মানুষের কাছে আমার অনেক আশা ছিল। ভেবেছিলাম, তারা এগিয়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবে এমন কিছু হয়নি। আবার কিছু মানুষ আমার জীবনে এসেছে ত্রাণকর্তা হয়ে। বিশ্বাস করুন, পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ আছে। না পাওয়ার সমীকরণ না খুঁজলে বুঝবেন, জীবনটা আসলেই খুব সুন্দর। স্রষ্ঠার অপূর্ব উপহার এই জীবন। আমরা এই উপহারকে যেন কখনো অবহেলা না করি।’
ঢাকা লিট ফেস্টের শেষ দিনে ‘হিলড’ শীর্ষক সেশনে নিজের লেখা বই ‘হিলড’ থেকে কয়েকটি লাইন দর্শকদের পড়ে শোনান মনীষা। নিজের জীবনে বয়ে যাওয়া ঝড়ের দিনগুলোর কথা বলেছেন এখানে। রোগ-শোকের ভয়াবহ সেসব দিন। তবে একটিবারের জন্য ভেঙে পড়েননি। প্রায় এক ঘণ্টার আলোচনায় কথা বলতে বলতে থেমে যাননি, বরং তাঁর জীবনের গল্প শুনে মিলনায়তনে উপস্থিত অনেকের চোখ সিক্ত হয়েছে। পিনপতন নীরবতায় মধ্যেও একজন দর্শক ফিসফিস করে বলে ওঠেন, ‘মনীষা সত্যিকারের যোদ্ধা!’
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক সাদাফ সায্। শুরুতে ‘নেপালিকন্যা’ মনীষা নিজের বইয়ে লেখা কয়েকটি অংশ পড়েন, ‘১০ ডিসেম্বর ২০১২। মরণ আমাকে ডাক দেয়। কিন্তু আমি মরতে চাইনি, বাঁচতে চাই এই সুন্দর পৃথিবীতে। আমার আকাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। না, হেরে গেলে চলবে না। একসময় জানতে পারি, আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৪৪ শতাংশ। কিন্তু এটাও সত্যি, ৫৬ শতাংশ মৃত্যুর ঝুঁকি!’
হিলড শিরোনামে আত্মজীবনীতে এসব কথা লিখেছেন মনীষা কৈরালা। আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হবে বইটি। যেখানে থাকবে নিজের জীবনের বোঝাপড়ার বিষয়। তাঁর জীবনের একটি বড় অধ্যায় ছিল ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া এবং তা থেকে মুক্ত হওয়া। সেটিও আলোচিত হয়েছে এ বইয়ে। কীভাবে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেছেন, আছে তা নিয়ে আলোচনা। তাঁর ভাষায়, ‘নিজের জীবনের নানা কথা, অভিজ্ঞতা, সফলতা আর ব্যর্থতার কথা আমি এই বইয়ে তুলে ধরেছি। আমার দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতার কথাও আছে। স্ত্রী হিসেবে আমি কতটা ব্যর্থ, সে কথা জানবে পাঠক।’

সঞ্চালক মনীষা কৈরালা তাঁর ‘হিলড’ বইয়ের পরিচিতি তুলে ধরেন দর্শকের কাছে
সঞ্চালক মনীষা কৈরালা তাঁর ‘হিলড’ বইয়ের পরিচিতি তুলে ধরেন দর্শকের কাছে

মনীষা বলেন, ‘সে সময় আমি জীবনের কঠিন একটি বাস্তবতার মধ্যে ছিলাম। খুব অস্বস্তি লাগত, শারীরিকভাবেও বিপর্যস্ত ছিলাম। সে কী অসহনীয় ব্যথা! তখন নেপালেই ছিলাম। চিকিৎসকেরাও তখনো বলতে চাননি যে আমার ক্যানসার হয়েছে। অনেক পরে আমাকে জানানো হয়, আমার জরায়ুতে ক্যানসার। সেটা কেটে ফেলে দিতে হবে। এটা শোনার পর মনে হলো আমার জীবনের নিঃসঙ্গ রাত শুরু। সে রাতের কথা মনে পড়ে। এমন রাত আগে কখনো আসেনি। বড্ড দীর্ঘ সে রাত!’
তাহলে কি কোন দুঃখ নেই কর্কটজয়ী মনীষার? ‘আছে, অস্ত্রোপাচারের পর জানতে পারলাম, আমি কখনো মা হতে পারব না। একটা অপ্রাপ্তি জীবনে থেকে গেল!’
ক্যানসার চিকিৎসা অনেকটা অনিশ্চয়তার বিষয় উল্লেখ করে মনীষা আরও বলেন, ‘মুম্বাইয়ের চিকিৎসকেরা যখন বলল, এই সার্জারি খুব জটিল, আমার বন্ধু, আত্মীয়, শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার জন্য যাই। ক্যানসার চিকিৎসা অনেক অনিশ্চয়তার বিষয়। শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। এই নিয়ে আমার বইয়ের একটা চ্যাপটার আছে, নাম ইন্তেজার (অপেক্ষা)।’
মনীষা যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন পুরো মিলনায়তনে পিনপতন নীরবতা। মনীষা বলেন, ‘আমি দেখি ক্যানসার চিকিৎসায় দুটি বড় শর্ত। প্রথমত, অপারেশন সফল হতে হবে। দ্বিতীয়ত, অপারেশনের পর পরবর্তী জটিল চিকিৎসা সফল হতে হবে। এর সঙ্গে আছে কেমোথেরাপি। এমনটা চিকিৎসকেরাই আমাকে বলেছিল। এসব জয় করে অপারেশন এবং চিকিৎসা সফল হলো। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি বাঁচব? তিনি বললেন, তিন বছর পর্যন্ত আবার ক্যানসার বেড়ে ওঠার ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা আছে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। আমি অপেক্ষায় ছিলাম, এখনো আছি। অপেক্ষা, অপেক্ষা আর অপেক্ষা।’ এক প্রশ্নের জবাবে একটু আক্ষেপের সুরেই বললেন মনীষা, ‘যখন জেনেছি মা হতে পারব না, তখন খুব খারাপ লেগেছিল। একসময় সামলে উঠেছি।’
দৃঢ়তার সঙ্গে মনীষা আরও বলেন, ‘আমি মরে যাব, এমনটা একমুহূর্তের জন্য ভাবিনি। আমার বিশ্বাস ছিল, আমি একদিন পুরোপুরি সুস্থ হব।’
দর্শকের প্রশ্ন নেওয়ার আগে হিলড আলোচনার শেষে আবারও নিজের বইতে থাকা কয়েকটি লাইন পড়ে শোনান। বললেন, ‘ক্যানসার আমাকে বদলে দিয়েছে। আমি ভেতর থেকে বদলে গিয়েছি। আমার পৃথিবীও বদলে গেছে।’ এ কয়েকটি লাইন পড়ে দর্শকের উদ্দেশে বললেন, ‘বাকিটা বইতে আছে। বই সংগ্রহ করে পড়ে নেবেন।’
দর্শকের সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে মনীষা আরও জানান রাজপরিবার থেকে দাদির (বাবার মা) অনুপ্রেরণায় চলচ্চিত্রে আসার কথা। তাঁর দাদি বলেছিলেন, ‘যে কাজটা তোমাকে আনন্দ দেয়, তুমি সেটাই করবে, যদি সেটা ঘাস কাটার কাজও হয়।’
মনীষা কৈরালার জন্ম ১৯৭০ সালে, কাঠমান্ডুর কৈরালা পরিবারে। কমিউনিস্ট নেতা ও নেপালের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বিপি কৈরালা মনীষার ঠাকুরদা (পিতামহ), চাচা গিরিজা প্রসাদ কৈরালাও পরে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ভারতে লেখাপড়া করতে গিয়ে চলচ্চিত্রে নাম লেখান। সুভাষ ঘাইয়ের ‘সওদাগর’–এর মাধ্যমে মনীষার বলিউডে অভিষেক। ‘নাইনটিন ফোরটি টু আ লাভ স্টোরি’, ‘আকেলে হাম আকেলে তুম’, ‘মন’, ‘ছুপা রুস্তম’, ‘তুম’, ‘অগ্নিসাক্ষী’, ‘গুপ্ত’, ‘দিল সে’, ‘লজ্জা’, ‘কোম্পানি’র মতো সফল বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।