যুগ পেরিয়ে মম

জাকিয়া বারী মম, ছবি: খালেদ সরকার
জাকিয়া বারী মম, ছবি: খালেদ সরকার
২০০৬ সালে লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার বিজয়ী হয়েছিলেন জাকিয়া বারী মম। তারপর থেকে অভিনয় করেছেন অসংখ্য নাটক ও চলচ্চিত্রে। ২০১৮ সালে পার করে এসেছেন অভিনয়জীবনের এক যুগ। কেমন ছিল এই দীর্ঘ ভ্রমণ? কত দূরই-বা এগোতে চান তিনি? কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

দরজা খুলতেই নাকে একটা গন্ধ এল। মাংস কষানোর ঘ্রাণ। অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম দরজা খুলে দিয়ে বসার ঘর দেখিয়ে দিলেন। জানতে চাইলাম, এই ঘ্রাণের উৎস কি পাশের বাসা?

একচোট হেসে নিলেন মম, ‘না, আমার রান্নাঘর। হাঁসের মাংস চড়িয়েছি, সঙ্গে চালের গুড়ার রুটি।’ বসতে বসতেই খানিকটা ইতস্তত করে বললাম, ‘নায়িকারা রান্না করার সময় পায়?’ এবার রে রে করে উঠলেন মম। শুনিয়ে দিলেন সেই চিরাচরিত বাণী, যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। তারপর মাংসে ঝোল দিতে হবে বলে উঠলেন। সহকারীকে কাজটা বুঝিয়ে দিয়ে এসে বসলেন মুখোমুখি।
অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম অভিনয়জীবনের এক যুগ পার করে, ১৩তম বছরটি শুরু করেছেন। বিগত এক যুগের ভ্রমণ নিয়ে কথা বলতেই সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছিলাম তাঁর উত্তরার বাসায়। আগের দিন নেপাল থেকে ফিরেছেন। শুরু করলেন নেপালের শীতের গল্প। সেসব শেষ হলে আমরা জানতে চাই ১২ বছরের কথা। মম ১২ বছর নয়, তারও আগের গল্প দিয়ে শুরু করেন। সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গল্প, যেখানে মমর বেড়ে ওঠা, ‘আমার বয়স যখন তিন-চার বছর, তখন থেকেই আমি নাচ শিখতাম। ঢাকায় আসার পর নাচে নিয়মিত হয়েছি। রতন স্যার (নৃত্যশিল্পী কবিরুল ইসলাম) আর মৌ আপুদের (সাদিয়া ইসলাম) যে সংগঠন নৃত্যলোক, সেখানে একটানা ১০ বছর নাচ করেছি।’

মম
মম

পুরোনো স্মৃতি, পুরোনো গল্প
পুরোনো স্মৃতি মেলে ধরেন মম। যেন পুরোনো বই। ঝেড়েমুছে লেখা পড়ছেন একেকটা, ‘আমার প্রথম টেলিভিশনে অভিনয় ২০০১ সালে। একুশে টিভির একটি নাটকে। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। মেহেরনিগার নামে নাটকে জাহিদ হাসানের বিপরীতে অভিনয় করেছিলাম। পরিচালক ছিলেন মিনহাজুর রহমান। মৌ আপার মাধ্যমেই টেলিভিশনে অভিনয় শুরু আমার।’
একটানা বলে থামেন। আমরা হিসাব করি, ২০০১ থেকে ২০১৯! ক্যারিয়ার তো ১৮ বছরের। মম থামিয়ে দেন—‘না, তখন তো কালেভদ্রে অভিনয় করতাম। ওটাকে ঠিক ক্যারিয়ার বলা যায় না।’
মমর হিসাবে ক্যারিয়ার শুরু ২০০৬ থেকে। লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর। সেবারের লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টারের অন্যান্য পুরস্কারের পাশাপাশি ঘোষিত পুরস্কার ছিল হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস দারুচিনি দ্বীপ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ। সেই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছিলেন মম।
চলচ্চিত্র দিয়েই ২০০৬ সালে নতুন এই লাক্স সুপারস্টারের অভিষেক হয়েছিল। তারপর আদতে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন বাদ দিয়ে একটা দারুণ ক্যারিয়ার পার করে এসেছেন এই অভিনেত্রী। অভিনয় করেছেন অসংখ্য একক ও ধারাবাহিক নাটকে। চলচ্চিত্রও আছে হাফ ডজন। জয় করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মানজনক স্বীকৃতি। এত কিছুর পরও মমর কাছে এই ক্যারিয়ার মাত্র ১২ বছরের এক কিশোরীর মতো। সামনে আরও বিস্তর পথ বাকি।

সবিশেষ
সব শেষ গত বছরের শেষে মুক্তি পেয়েছ স্বপ্নের ঘর নামে একটি ছবি। ভৌতিক এই ছবি দর্শক পছন্দও করেছেন বেশ। আরও কয়েকটি ছবি আছে মুক্তির অপেক্ষায়। জানতে চাই, সামনে আর কত দূর যাওয়ার ইচ্ছা? মম নড়েচড়ে বসেন। কথার এক ফাঁকে হাঁসের মাংস নামিয়ে এসেছেন। সেটার গন্ধ পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা ঘ্রাণে অর্ধভোজন করতে করতে এগোই। মম বলেন, ‘আমি পড়াশোনা করছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগে। সেলিম আল দীন স্যারের ক্লাস করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শিখে আসা বিদ্যার ৩০ ভাগও দিতে পারছি না। এই দিতে না পারা আক্ষেপটা আমাকে খুব কষ্ট দেয়।’

না পারার কারণটা কী?
‘অভিনয় করার মতো অসাধারণ গল্প পাই না। যা পাই, সেটাতে তৃপ্তি হয় না।’ কথায় বোঝা যায়, একজন জাত অভিনেত্রীর ক্ষুধা নিয়ে বসে আছেন মম। এবার নিজে থেকে বলা শুরু করেন, ‘আমি আসলে আগাগোড়া অভিনেত্রীই হতে চেয়েছি। এই ১২ বছরে অনেক কাজ করেছি হয়তো। কিন্তু মনের মতো, নিজেকে তৃপ্ত করার মতো কাজ থেকে হয়তো দূরে আছি। তবে সামনে হয়তো আরও অনেক দিন কাজ করব। কারণ, এটা ছাড়া তো আর কিছু শিখিনি। অভিনয় যতদিন আমাকে ভালোবেসে যােব, আমি ততদিন অভিনয় করে যাব। যখন বুঝতে পারব আমি এই পেশায় আর তাল মেলাতে পারছি না, তখন হুট করে ছেড়েও দিতে পারি।’

তবে এত দূর আসার পেছনে সব পরিচালককে ধন্যবাদ দিলেন। তবে সবচেয়ে বড় কৃতজ্ঞতা জানালেন মা-বাবাকে, ‘যাঁদের সহযোগিতা, ভালোবাসা বা চেষ্টা না থাকলে আমি আজকের মম হতে পারতাম না, তাঁদের ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই।’

প্রসঙ্গ যখন হ্যাশট্যাগ মি টু?
এবার একটু স্পর্শকাতর প্রসঙ্গে আলাপ তুলি। গত বছর বিশ্বজুড়ে হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন জোরদার ছিল। আপনি প্রতিযোগিতা পার করে এসে এই জগতে ১২ বছর কাটিয়ে দিলেন। আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?

মম একটু সময় নেন। তারপর ভেবে বলেন, ‘নিজেকে সামলে চলার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। ভালো কাজের কদর এখনো আমাদের এখানে আছে। নিজের সেরাটা দিয়ে তাই কাজ করে যাওয়াই ভালো। আমি এ ধরনের কিছুর মুখোমুখি হইনি কখনো।’

বাকিটা ব্যক্তিগত
ব্যক্তিগত বিষয়ে খুব বেশি বলতে চান না মম। পাঠকের দোহাই দিয়েই জানতে চাই, ‘ইদানিং আপনার সঙ্গে এক পরিচালকের প্রেম ও বিয়ের কথা শোনা যায়। ঘটনা কতটা সত্যি?’
প্রশ্ন শুনে হাসেন। বলেন, ‘এটা জানা কি খুব জরুরি?’ ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর শুনে সেই চিরাচরিত বাক্য ছুড়ে দেন। ‘যা রটে তার কিছুটা বটে।’

এরপর এই বাক্যের সম্প্রসারণ করেন এভাবে। ‘আমি মনে করি সবাইকে সব সময় প্রেমে বা বিয়েতে থাকতে নেই। কারণ সংসার খুব কঠিন জায়গা। যেখানে সবাই খাপ খাওয়াতে পারে না। আমি যেমন নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। সংসারটা আমার জন্য কঠিন জায়গা। আসলে একটা ছুঁতে গেলে আরেকটা হয় না।’
মম এর আগে বিয়ে করেছিলেন আরেক নাট্য নির্মাতাকে। প্রশ্ন করি, ‘আপনি বারবার নির্মাতাদের প্রেমে পড়েন? এটার বিশেষ কোনো কারণ আছে?’
এমন প্রশ্নের জন্য সম্ভবত প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। বললেন, ‘এটা আসলে পুরোটাই কাকতালীয়। আসলে একসঙ্গে কাজ করতে গেলে, পেশার জায়গা থেকে এমনটা হয়ে যায়। এটা নিয়ে কখনো এভাবে ভাবিনি। তবে এখন আমার পুরোপুরি প্রেম কাজের সঙ্গে। আমার অভিনয়ের সঙ্গে।’
কথা শেষ করতে হয়। ততক্ষণে চালের গুড়ার রুটি হয়ে গেছে। টেবিলে সেসব সাজিয়ে ডাক দেন ১২ বছর ধরে দাপুটে অভিনয় করতে থাকা মম।

২০০৬ সালের ছবি দারুচিনি দ্বীপ ছবিতে রিয়াজের সঙ্গে মম
২০০৬ সালের ছবি দারুচিনি দ্বীপ ছবিতে রিয়াজের সঙ্গে মম
মমর প্রিয়
প্রিয় অভিনেতা আমির খান, নাসিরুদ্দিন শাহ, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী
প্রিয় অভিনেত্রী
জয়া আহসান, রাধিকা আপ্তে ও আলিয়া ভাট
প্রিয় চলচ্চিত্র
সম্প্রতি সুজিত সরকারের অক্টোবর এবং নূর ইমরান মিঠুর কমলা রকেট দেখেছি। খুব ভালো লেগেছে।
প্রিয় পরিচালক
সুজিত সরকার ও নন্দিতা দাশ।
প্রিয় নাটক
মঞ্চনাটক গ্যালিলিও।
মম বললেন, এক যুগের ৬ অর্জন
* ১২ বছর ধরে অভিনয় করতে পারছি, এটাই বড় অর্জন।
* সবার ভালোবাসা পাই, কোথাও গেলে সম্মান পাই, এটাও একটা অর্জন।
* প্রথম ছবি হিসেবে দারুচিনি দ্বীপ–এর মতো ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ ছিল এক বিশাল পাওয়া।
* জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শিল্পী হিসেবে আমার জীবন বদলে দিয়েছে।
* ছুঁয়ে দিলে মন ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য অভিনেত্রী হিসেবে আমার জন্য টার্নিং পয়েন্ট ছিল।
* শিহাব শাহীনের নাটক নীলপরী নীলাঞ্জনা ও তৌকীর আহমেদের স্বর্ণমায়াতে অভিনয় আমার জীবনের বিশাল প্রাপ্তি।