টানা আট বছর আমি শুধু দেশের গান করেছি: আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ছবি: প্রথম আলো
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ছবি: প্রথম আলো
>একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন আমাদের দেশের বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী অনেকেই। তাঁদেরই একজন প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অস্ত্র ফেলে যিনি আবার হাতে তুলে নিয়েছেন গিটার। সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান। ২০০৭ সালের ২২ মার্চ সাক্ষাৎকারটি প্রথম আলোর ‘আনন্দ’ পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আজ মঙ্গলবার মারা গেছেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাক্ষাৎকারটি আবার দেওয়া হলো।

আপনি একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কোন সেক্টরে থেকে যুদ্ধ করেছেন? স্মৃতি হাতড়ে সেই সময়ের কিছু কথা বলবেন কি?
আমি ২ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে যুদ্ধ করি। তখন আমার বয়স সাড়ে ১৪ বছর। আগরতলায় আমরা প্রশিক্ষণ নিই। মনে পড়ে, আমরা চারজন একসঙ্গে রেকি করতাম—মানিক, মাহবুব, খোকা আর আমি। কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত সড়কে পাক হানাদারেরা কতগুলো দুর্গ করেছে, সেগুলো দেখে আসতাম। এক সময় পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিলাম, ওরা আমাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সে এক বড় কাহিনি। একদিন সে কথা বলব।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ছবি: প্রথম আলো
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ছবি: প্রথম আলো

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার ফিরে এলেন সংগীতে। সেই সময়ের কথা বলবেন?
আমি একজন গিটারবাদক ছিলাম। যুদ্ধের দিনের কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই রোমহর্ষক দিনগুলোর স্মৃতি, হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য। যাঁদের হারিয়েছি, অনুভব করলাম তাঁদের জন্য কিছু করা দরকার। সেই থেকে টানা আট বছর আমি শুধু দেশের গান করেছি। অন্য গান করিনি।

আপনার সৃষ্টি অসংখ্য কালজয়ী দেশের গান আছে। এর মধ্যে আপনার পছন্দ কোনগুলো?
আমার সুর করা প্রায় সবগুলো দেশের গানের শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। এর মধ্যে প্রয়াত নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব ঘুরে এক ব্রহ্মচারী থমকে দাঁড়াল’, ‘এই দেশটা আমার স্বপ্নে বোনা নকশিকাঁথার মাঠ’, ‘যুদ্ধ এখনো থামেনি তাই তো তোমার ছেলে আসেনি’, ‘ও আমার আট কোটি ফুল দেখো গো মালি’ (এ গানটির শিল্পী রুনা লায়লা)। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘মাগো আর তোমাকে ঘুমপাড়ানি মাসি হতে দেব না’, ‘আমার বাজান গেল কই বাজার থিকা আনতে গিয়া চিড়া মুড়ি দই’, ‘একদিন ঘুম ভেঙে দেখি তুমি নাই’, ‘ওকে আর করল না তো কেউ বিয়ে’। মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের লেখা ‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে’, মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা ‘একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না’, এস এম হেদায়েতের লেখা ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’ এবং আমার লেখা ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য অপূর্ব রূপসী রূপেতে অনন্য’, ‘এই দেশ আমার সুন্দরী রাজকন্যা’, ‘একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল’, ‘ওগো বীর মুক্তিযোদ্ধা লও লও মুক্তির ফুল’, ‘আয় আয় আয়রে মা আয়রে আমার কোলে’ ইত্যাদি।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

দু-একটা গানের প্রেক্ষাপট বলা যাবে?
‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’—গানটির কথা বলি। ১৯৮২ সালে বিটিভির ২৬ মার্চের বিশেষ সংগীতানুষ্ঠানের জন্য গানটি করা। আমার সঙ্গে বসে গানটি লিখেছিল নজরুল ইসলাম বাবু। গানটির প্রেক্ষাপটটি বাবুকে আমিই দিই। আমার সব সময় মনে হয় এবং আমার বিশ্বাস, যারা শহীদ হয়েছেন, সেই মুক্তিযোদ্ধারা কখনো মরেননি। তাঁরা আসেন, দেখেন আমরা কী করছি। গানে ‘জানালা’ শব্দটি আমার দেওয়া। বাবু ব্যবহার করতে চাইছিল না। ওর কাছে শব্দটি কর্কশ লেগেছিল। আমি বলেছিলাম, শব্দটি মোলায়েমভাবে ব্যবহার করব। গানটি ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে ধারণ করা হয়েছিল। রেকর্ডিস্ট ছিলেন প্রয়াত শাফায়াত খৈয়ম। গানে গিটার বাজিয়েছিলেন টিপু এবং প্রয়াত শেখ ইশতিয়াক। তবলায় ছিলেন দেবু ভট্টাচার্য। ভায়োব্রোফোন বাজিয়েছিল মানাম আহমেদ। কি-বোর্ড এবং বেজ গিটার বাজিয়েছিলাম আমি।

আপনার অধিকাংশ গানের গীতিকার প্রয়াত নজরুল ইসলাম বাবু। তাঁর সঙ্গে আপনার সমন্বয় ঘটল কীভাবে?
ওর সঙ্গে আমার পরিচয় শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিওতে। ও প্রায়ই সেখানে আসত। আমার সঙ্গে পরিচয়ের পর ও আমাকে ওর গীতিকবিতার ভান্ডার দেখাল। দেখলাম অপূর্ব ওর শব্দচয়ন, চিন্তা-ভাবনা, লেখার মধ্যে পাণ্ডিত্য। আমি মুগ্ধ। এরপর ওর সঙ্গে নিয়মিত কাজ শুরু করি।

আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সেরা মুক্তিযুদ্ধের বা দেশের গান কোনগুলো?
দুটো গান আমার খুব প্রিয়। সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধায় হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে’, অন্যটি সৈয়দ আবদুল হাদীর গাওয়া ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’—এ দুটো গান আমাকে খুব স্পর্শ করে।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

এখন কেন এ ধরনের গান সৃষ্টি হচ্ছে না?
সত্যি করে যদি বলি, বলব—আমাদের কারও মধ্যে বোধ হয় এখন দেশপ্রেমটা নেই। স্বাধীনতার ১০-১২ বছর পর থেকে সবার মন থেকে দেশপ্রেমটা চলে গেছে। তবে এখনো আমি আশাবাদী—যদি সুন্দরভাবে দেশটা পরিচালিত হয়, তবে আবার এ ধরনের গান সৃষ্টি হবে।

ব্যর্থতার দায়ভার কিছুটা আপনাদের কাঁধেও কি পড়ে না?
হয়তো পড়ে। আবার পড়ে না। কারণ আমার মনে হয়, যাঁরা এ ধরনের কাজ শুরু করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। যদি হতো, তবে এ ধরনের গানের আকাল পড়ত না। আজ দুঃখ করে বলি—একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সংগীত পরিচালক হিসেবে সরকারের কাছে ৫০ হাজার টাকা জমা দিয়ে আড়াই কাঠা জমির জন্য দরখাস্ত করেছিলাম।’ ৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আমাকে আড়াই কাঠার প্লট বরাদ্দ করে। কিন্তু পরবর্তী সরকার এসে আমার সেই প্লট কেড়ে নেয়। এরপর আমি অনেক মন্ত্রীর কাছে ধরনা দিয়েছি। কিন্তু আজও সেই জমি ফিরে পাইনি। রাজউকে আমার ৫০ হাজার টাকা এখনো গচ্ছিত আছে। সেই দুঃখে আমি লিখেছিলাম, ‘আমি জায়গা কিনব কিনব বলে পেয়ে গেলাম জায়গাসুদ্ধ বাড়ি’ (গানটি সামিনা চৌধুরী গেয়েছেন)। শুধু আমিই এমন ভুক্তভোগী নই। শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। দেশকে যাঁরা প্রকৃত ভালোবেসেছেন তাঁদের মূল্যায়ন কখনোই হয়নি। হয়েছে যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে তাদের।