এফডিসিতে বুলবুলের মরদেহ আনার কী দরকার ছিল?

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

ফেসবুকের বদৌলতে চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের অনেক ধরনের পার্টির খবর পান ভক্ত-অনুসারীরা। এসব পার্টিতে তারকাদের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মতো। অথচ চলচ্চিত্রের কারও শেষবিদায়ে দেখা যায় না দেশের চলচ্চিত্রের এসব তারকাকে। মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রম দেখা গেলেও তা সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নয়। দেশের চলচ্চিত্রের তিন শতাধিক গানের গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের শেষবিদায়েও সেটাই প্রমাণিত হলো।

মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করার আগে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ আনা হয়েছিল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি)। গুণী এই মানুষটি যতক্ষণ ছিলেন, ততক্ষণ দেখা যায়নি তাঁর গানের সঙ্গে সিনেমার পর্দায় ঠোঁট মেলানো নায়ক-নায়িকাদের কাউকেই। একেবারে শেষ মুহূর্তে এসেছিলেন চিত্রনায়ক রিয়াজ। বিষয়টি নিয়ে গানের মানুষদের অনেকেই ব্যথিত হয়েছেন। হতাশ হয়েছেন বাকিরা।

আজ বুধবার সকাল ১০টায় কানাডা থেকে বাংলাদেশে এসেছেন গুণী সংগীতশিল্পী তপন চৌধুরী। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাসায় যাননি তিনি। শেষবারের মতো দেখতে যান আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। এফডিসিতে এসে তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘চলচ্চিত্রের মানুষ তো বেশি নেই। গানের মানুষই বেশি। বুলবুল ভাইয়ের গানে পর্দায় যাঁরা ঠোঁট মিলিয়েছেন অন্তত তাঁরা যদিও আসতেন, ভালো লাগত। কথা শেষে বিদায় নেওয়ার আগে বলে গেলেন, পত্রিকায়ও তো এসব নিয়ে কিছু লেখা হয় না।’

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মহাভক্ত সাভারের এস এম বাশার। দেশের সংগীতের গুণী এই মানুষটির লেখা ও সুর করা বহু গান তাঁর মুখস্থ। অবলীলায় যেভাবে গান ও গানের শিল্পীদের কথা বলছিলেন, মনে হবে চলন্ত আর্কাইভ। জানালেন, শহীদ মিনারে গিয়েছিলেন, কিন্তু তার আগে সেখানকার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে যায়। এরপর জ্যাম ঠেলে আসেন এফডিসিতে। নিরাপত্তারক্ষীদের বুঝিয়ে ভেতরে ঢোকেন। প্রশাসনিক ভবনের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বেড়ে ওঠা এই মানুষটার গান শুনে। কখনো তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। যেদিন হলো, সেদিন তিনি নীরব-নিথর, শুয়ে আছেন। চলচ্চিত্রে তাঁর গানে অনেকে ঠোঁট মিলিয়েছেন। ভেবেছিলাম, অনেক নায়ক-নায়িকা থাকবেন। কিন্তু এখানে এসে পুরাই থ হয়ে গেছি।’

সোমবার ৬৩ বছর বয়সে নিজ বাসায় মারা যান বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাঁকে পিজি হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। আজ সকালে সেখান থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে নেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে প্রথম জানাজার পর এফডিসির প্রশাসনিক ভবনের সামনে ঘণ্টাখানেকের জন্য আনা হয় তাঁর মরদেহ। চলচ্চিত্রের আঁতুড়ঘর এফডিসিতে পাওয়া যায়নি চলচ্চিত্রের মানুষদের। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ এফডিসিতে নিয়ে আসার আগে তাঁর জন্য বানানো মঞ্চের সামনে মাইকে কথা বলছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার। পাশেই ছিলেন পরিচালক শাহ আলম কিরণ, এস এ হক অলিক, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান, নৃত্য পরিচালক মাসুম বাবুল, প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু। সেখানেই কথা হয় সংগীত পরিচালক শওকত আলী ইমনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বুলবুল ভাইয়ের শেষ যাত্রায় হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সেই অর্থে কাউকে দেখছি না।’

চলচ্চিত্রের তারকারা না থাকলেও সংগীতাঙ্গনে তারকারা ছিলেন শহীদ মিনার, বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদ, এফডিসিতে। যেন অগ্রজের শেষযাত্রায় যতটা সময় থাকা যায়, সেটাই শান্তি তাঁদের কাছে। এফডিসিতে দেখা গেছে কনকচাঁপা, মনির খান, রবি চৌধুরী, মাইনুল ইসলাম খান, ইজাজ খান স্বপন, শফিক তুহিন, কিশোর, মুহিন, সাব্বির, জে কে মজলিশসহ আরও কয়েকজনকে । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই মন্তব্য করেন, এত আয়োজন করে এফডিসিতে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে আনার কী দরকার ছিল? শহীদ মিনারে উপস্থিত মানুষগুলোই এসেছেন এফডিসিতে। চলচ্চিত্রের তারকারা না থাকলে এভাবে মরদেহ এনে সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই হলো না। কেউ কেউ তো এমনও বললেন, ‘সিনেমারা তারকারা কি মৃত মানুষ দেখতে ভয় পান? নাকি ওদের পরিবারে কেউ মারা যায়নি।’

বাংলাদেশের প্রখ্যাত গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার এ ঘটনায় কষ্ট পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটা খুবই খারাপ একটি চর্চা। এমন কোনো ব্যস্ততা বা কারণ না থাকলে একজন সহকর্মীকে অবশ্যই শেষবিদায় জানাতে আসা উচিত। কারণ এফডিসিতে মরদেহ নিয়ে আসা হয়, এখানকার সবাই যাতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পারে সেই জন্য। একজন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল রোজ রোজ জন্মায় না, কয়েক দশকে একজন আসেন। তা ছাড়া একদিন আমিও মারা যাব। আমি আজ কারও সম্মানে না গেলে, আমাকেও কেউ দেখতে যাবে না।’