সবকিছু একটা সীমার মধ্যে আটকে আছে

হ্যািপ ডেইজ নাটকে জ্যোতি িসনহা। ছবি: সনজু সিংহ
হ্যািপ ডেইজ নাটকে জ্যোতি িসনহা। ছবি: সনজু সিংহ

আইরিশ নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের দ্বিতীয় কোনো নাটক প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হলো বাংলাদেশে। ওয়েটিং ফর গডোর পর সম্প্রতি এই যে তাঁর হ্যাপি ডেইজ নাটকের মঞ্চায়ন ঘটল এত দিন বাদে, দেশের নাট্যজগতে নিঃসন্দেহে এ এক ঘটনাই বটে। আর নাটকটির কুশলী মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে আরও যেসব ঘটনার ঘনঘটা, তাকেও তো ‘চ্যালেঞ্জিং’ই বলতে হবে। যেমন: পুরো নাটকে অভিনয় করল একটি মাত্র চরিত্র—উইনি। আবার অভিনয়ও হলো একটি নির্দিষ্ট স্থানে, কিছুমাত্র জায়গার মধ্যে। কিন্তু তাতে দর্শক হিসেবে কি আমরা ক্লান্ত বোধ করলাম? ক্রমাগত কথার মারপ্যাঁচে জমে উঠল যে দৃশ্য—দৃশ্যের পর দৃশ্য, শেষ পর্যন্ত সেসবের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেঁটে থাকল কি আমাদের চোখ? ১ ঘণ্টা ৫ মিনিটের সংলাপনির্ভর এই প্রযোজনায় নানা ভঙ্গিমা এবং বিচিত্র ঢঙে অনর্গল কথা বলে গেলেন জ্যোতি সিনহা, ওরফে উইনি। কিন্তু উইনির সংলাপগুলো আমাদের সমকালীন স্থবিরতার দিকেও কি অঙ্গুলিনির্দেশ করল অগোচরে?

এসব প্রশ্নের পর অবধারিতভাবে উত্তর বাতলানোর দায় এসে যায়। সেখানে আসছি পরে। প্রথমে বলে রাখি, ফরাসি দূতাবাসের প্রযোজনা ও আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় মঞ্চস্থ হ্যাপি ডেইজ নাটকের নির্দেশক শুভাশিস সিনহা। ১ ফেব্রুয়ারি শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে এটি যখন মঞ্চস্থ হচ্ছিল, আমরা ডুবে যাচ্ছিলাম নিরর্থকতা ও বিষণ্নতার এক ভয়ংকর জগতে। পাশাপাশি আমাদের মনে পড়ছিল, নাটক–সম্পর্কিত দু-একটি তথ্যও: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে পৃথিবীতে তখন নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। মানুষের স্বপ্ন-আশা যখন সুদূর পরাহত, তার বেশ কিছুকাল পরে লেখা এ নাটক প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে। এর পাত্র-পাত্রী দুজন, উইনি ও তার স্বামী উইলি। নাটকে চরিত্র হিসেবে উইলি যতটা নিষ্ক্রিয়, উইনি ততটাই সরব।

আলোচ্য প্রযোজনাতেও উইনিকে যথেষ্ট মুখরই দেখা গেল। বলা ভালো, গোটা প্রযোজনা মাতিয়ে রাখলেন উইনি চরিত্রের জ্যোতি সিনহাই। অন্যদিকে, উইলি এখানে এক অদৃশ্য চরিত্র। রূপান্তরের মাধ্যমে পরিবেশিত এবং পুরোপুরি অভিনয়সমৃদ্ধ এই প্রযোজনায় নির্দেশক মোটাদাগে কয়েকটি কাণ্ড ঘটিয়েছেন। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষার মিশেলে। তবে এতে নাট্যক্রিয়া কোথাও এতটুকুও টোল খায়নি, এমনকি ইংরেজি না জানা দর্শকেরও বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি। অভিনয়ক্ষেত্র ছিল একটি মাত্র গুহাসদৃশ স্থান। গুহার সেই নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে দাঁড়িয়ে, কখনো বসে, কখনোবা গুহার ওপরে উঠে একের পর এক জ্যোতি আওড়ে যাচ্ছেন মর্মঘাতী সব সংলাপ: ‘সবকিছু একটা সীমার মধ্যে আটকে আছে’, ‘এমন সময় আসে যখন ভাষাও অক্ষম হয়ে পড়ে, তখন তা (ভাষা) যদি আবার ফিরে না আসে, মানুষ কী করবে?’

কেবল স্বগতোক্তির মতো বলে যাওয়া। গল্প বলা বেকেটের স্বভাববিরুদ্ধ। স্বভাবতই কোনো গল্প নেই এ নাটকে। কিন্তু গল্পহীনতার মধ্যেও এই স্বগতোক্তি-উচ্চারণগুলো যেন আমাদের সামনে উন্মোচন করে এই সময়ের বাস্তবতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এ দেশের সময়, সমাজ ও সমকাল মিলেমিশে এমন একাকার হয়ে যায় কেন!

গোটা নাট্যপ্রযোজনায় দারুণভাবে ঘটেছে ফিউশনের কারবার। ভাষার ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছে বাংলা ও ইংরেজির রাখিবন্ধন, তেমনি অভিনয়শৈলীতেও আছে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মেলবন্ধন। আগেই বলা হয়েছে, নাটকের অভিনয়শিল্পী একজনই—জ্যোতি সিনহা। এত দিন আমরা জ্যোতির বর্ণনাত্মক বাংলা অভিনয়রীতির সৌরভে মুগ্ধ হয়েছি। তবে পাশ্চাত্য ধারার সংলাপাত্মক অভিনয়েও যে তিনি সাবলীল, তার অনুপম নিদর্শন হ্যাপি ডেইজ। পুরো নাটকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে জ্যোতিকে দেখতে দেখতে দর্শকের তো ক্লান্ত হওয়ার কথা। তবে তেমন ঘটার জো থাকে না এই তরুণ অভিনয়শিল্পীর অনিন্দ্যসুন্দর অভিনয়গুণেই।

কৃতিত্ব এখানে নির্দেশক শুভাশিস সিনহারও কম নয়। নির্দেশনাশৈলীসহ আলোক, মঞ্চ এবং বিশেষত সংগীত পরিকল্পনায় এককথায় ‘কামাল’ করে দিয়েছেন তিনি। কল্পনা করুন তো, বেকেট সাহেবের নাটকের আবহ সংগীত হিসেবে বাজছে রবীন্দ্রসংগীত, এ আর রাহমান, আনুষ্কা শংকর, এরপর সবকিছু ভেঙেচুরে আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’। সবই বঙ্গীয় হ্যাপি ডেইজ-এ বাস্তবে ঘটেছে। নাটকটিতে শুভাশিস ভেঙেছেন তাঁর চেনা ভঙ্গি। অ্যাবসার্ড নাটকের পরিচিত খোলস ভেঙে বেকেটের নাটকের সর্বজনীন আবেদনকে সহজভাবে পৌঁছে দিয়েছেন দর্শকহৃদয়ে। এ ছাড়া এখানে তিনি আরও কী কী করেছেন, ইচ্ছাকৃতভাবেই সে বিষয়ে আর বিশদ বলব না, শুধু বলব, নাটকটি চর্মচক্ষে দেখলেই আপনার কাছে মালুম হবে সবকিছু।