প্রশ্নের মুখোমুখি নির্দেশক ও অভিনেত্রী

বেহুলা, আমি এবং সতীত্ব নাটকের মহড়ায়
বেহুলা, আমি এবং সতীত্ব নাটকের মহড়ায়

ইন্দ্রর সভায় নৃত্য করে বর পেয়েছে বেহুলা। সে বরে ফিরে পেয়েছে স্বামী লখিন্দরের প্রাণ। আবার হবে বাসররাত। কিন্তু লখাইর মন খারাপ। তার মনে প্রশ্ন—বেহুলা কি সতী? ইন্দ্রসভায় হরণ হয়নি তাঁর সতীত্ব? বেহুলাকে নিয়ে লখাইর এই প্রশ্ন এই শতাব্দীতে এসে ধরা দেয় মেহেদী তানজীরের মনেও। তিনিও কি সমাজের একজন লখাই? প্রশ্ন তোলেন বেহুলার সতীত্বের। আর সেটি আরও দানা বেঁধে ওঠে, যখন খবরের কাগজে দেখেন ধর্ষণের স্থলে লেখা হয় সতীত্বহানির ঘটনা।

নিজের এই প্রশ্ন আর উপলব্ধিকে বুঝতে নির্দেশক মেহেদী তানজির ও তাঁর স্ত্রী লাবনী আকতার মিলে আয়োজন করেছেন একটি নাটকের। নাম—বেহুলা, আমি এবং সতীত্ব। যেহেতু দুজনেরই নিজেদের প্রকাশ করার অন্যতম জায়গা থিয়েটার, তাই লখাই ও বেহুলার ভেতরের দ্বন্দ্বটাকে বুঝতে নিজেরাই ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রযোজনা নির্মাণে। তাই এটি যতখানি না একটি নাটক তার চেয়েও বেশি নিজেদের উপলব্ধিগুলোকে বোঝাপড়ার একটি চেষ্টা। পরিচালক মেহেদী তানজীর বলেন, ‘একজন পুরুষ নির্দেশক হিসেবে অভিনেত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক থাকায় অভিনেত্রীর মানসিক অবস্থান আমার কাছে কিছুটা হলেও পরিষ্কার। বারবার নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হই তার সঙ্গেও। তা ছাড়া জীবন চলার পথে প্রায়ই নানান প্রশ্ন ও বাস্তবতার মুখোমুখি হই আমরা। নিজেকে দাঁড় করাই কখনো লখিন্দরের রূপে কখনো বা বেহুলার বেদনায়। প্রতিনিয়ত খুঁজে বেড়াই নিজেকে। নিজেকে বুঝতে চাই, প্রমাণ করতে চাই, আমি কোন দলে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, আদৌ কি তার প্রয়োজন আছে? যেখানে “সর্বাং অনিতাং” অর্থাৎ সবকিছু নিত্য পরিবর্তনশীল। বেহুলার সতীত্ব খুঁজি আমি, সেই সততা আছে কি আমার? সতীত্বের ধারণা শুধু কি শরীরসর্বস্ব? তার চেয়ে বরং আমরা কেন বিলীন হতে পারি না মানবপ্রেম আর ভালোবাসায়। কার সাধ্য সেখানে সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই বোঝাপড়ার জন্যই এই প্রযোজনার আয়োজন।’

রোববার সন্ধ্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরে কথা হয় নির্দেশক, অভিনেত্রী ও আলোক পরিকল্পকের সঙ্গে। পরিচালকের ঘাড়ে ইয়া বড় ব্যাগ। তার মধ্যেই নাকি নাটকের সব দ্রব্যসামগ্রী। অভিনয়কে খুব আয়োজনের জঞ্জাল থেকে মুক্ত করে সহজেই মহড়া করার বন্দোবস্ত এটি। তাই ব্যাগেই থাকে অভিনয়ের যাবতীয় প্রপস। সুযোগ থাকলে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে চলে আসেন দুজন। কারণ ত্রিশালের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটকের শিক্ষক মেহেদী। এরপর টিএএসিতে চলে মহড়া। নির্দেশক জানান, মনসামঙ্গলের প্রেক্ষাপটে জাকির তালুকদারের ‘বেহুলার দ্বিতীয় বাসর’ গল্প থেকে অনুপ্রাণিত এই নাটক। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কাহলিল জিবরানের কবিতা ও গৌতম বুদ্ধের দর্শন। আর নাটকটি যেহেতু শেষ পর্যন্ত নির্দেশক ও অভিনেত্রীর নিজেদের জীবনেরই প্রশ্ন ও উত্তর খোঁজার ব্যাপার—তাই নাটকটি আর নাটক হয়ে ওঠেনি। উঠেছে নির্দেশক ও অভিনেত্রীর নিজেদের জীবনের বয়ান।

লাবনী আকতার বললেন, ‘হঠাৎ করেই চারদিক থেকে ধর্ষণের খবর আসে, তা যখন নারীর সতীত্বহানির খবর হিসেবে প্রকাশ হয় তখন প্রশ্ন জাগে নিজের মনেও। মধ্যযুগীয় নারী বেহুলার প্রতি লখিন্দর সতীত্ব নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছে, তা কি এই সমাজেও নেই? আমার স্বামীও কি আমার প্রতি ওই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকিয়ে আছে? অথবা লখাইর এই প্রশ্ন তোলা কি স্বাভাবিক নয়? এরই বোঝাপড়ার চেষ্টা করেছি।’

নাটকটি হয়ে ওঠে তাই আরও বেশি জীবনঘনিষ্ঠ। নির্দেশক জানান, ‘কেন এই প্রযোজনা প্রয়োজন, এমন ভাবনাটি শুরু থেকেই গুরুত্ব পেয়েছে আমাদের কাছে। চারদিকে ধর্ষণ এবং তাতে নারীর সতীত্বহানি–সংক্রান্ত খবর প্রকাশ লাবনীকে বিষণ্ন করে তোলে। লাবনীর নিজের সাইকো-ফিজিক্যাল বহিঃপ্রকাশের সঙ্গে দক্ষিণ এশীয় আখ্যান ‘পদ্মপুরাণ’ উপজীব্য করে এই সমাজের ভাবগত অবস্থান মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন বোধ করি। পুরাণের নারী আর সমাজের নারীর প্রতি আমাদের মনোভাব খুঁজে দেখতে চাই।’

কথা বলতে বলতে রাত হয়ে যায়। মেহেদী ও লাবনী উঠে দাঁড়ান। যেতে হবে ত্রিশাল। আমরাও বিদায় নিই। নাটকটি আসবে মহড়ার ব্যানারে। আগামী মার্চ মাসেই শুরু হবে প্রদর্শনী। নাটকটির কোরিওগ্রাফি করেছেন মাশরুর ম্যাশ। আলোক ও পরিকল্পনা করেছেন আসলাম অরণ্য।