বোধে ধাক্কা দিয়ে গেল বুদেরামের কূপে পড়া

বুদেরামের কূপে পড়া নাটকের দৃশ্য। ছবি: অংশুমান ভৌমিক
বুদেরামের কূপে পড়া নাটকের দৃশ্য। ছবি: অংশুমান ভৌমিক

একজন মানুষ মরতে গিয়েও যখন বাঁচতে চান, তখন বোঝা যায় তাঁর জীবনের যন্ত্রণা মৃত্যুকে হার মানিয়েছে। তিনি মরতে চাইলেন। তাঁকে ফেলে দেওয়া হলো জলশূন্য জঞ্জালে ভরা এক কূপের মধ্যে। সেখানে তাঁর মৃত্যু হলো না, বরং মৃত্যুর চেয়েও বেশি যন্ত্রণা ভোগ করলেন। জীবন-মৃত্যু বিড়ম্বনায় তিনি বলে উঠলেন, ‘মরব বলে কি বাঁচব না!’ সাধারণের দুঃখসহ এই যাতনার বিদ্রূপাত্মক উপস্থাপন হচ্ছে নাটক বুদেরামের কূপে পড়া। এটি অনুশীলন নাট্যদলের ৬৩তম প্রযোজনা। রচনা ও নির্দেশনায় নাট্যকার মলয় ভৌমিক।

নাটকের প্রধান চরিত্র বুদেরাম বাস্তুচ্যুত মানুষ। যেই দোষ করুক, প্রধানের চড়টি তাঁর গালেই গিয়ে পড়ে। জনগণ যেভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের দহনজ্বালা বুকে নিয়ে তারই জয়গান করে, বুদেরামও সেভাবেই হাসেন। হাসতে হাসতে মরতে চান। তাঁর ইচ্ছে, তিনি একটি পুরোনো কূপে পড়ে মরবেন। সেই রকম একটি কূপ খুঁজে বের করে তার মধ্যে নিজেকে নিক্ষেপ করার জন্য দুজন পেশাদার লোকও ভাড়া করেন বুদেরাম। ভাড়াটেরা তাঁকে কাঁধে নিয়ে কূপ খুঁজতে থাকেন। যেতে যেতে তাঁরা ব্যঙ্গরসাত্মক নানা কথা বলেন। তাঁদের কথায় আর হাসির আড়ালে নির্মম বাস্তবতার এক চাবুক দর্শকের মনকে বিষণ্ন করে তোলে।

বুদেরাম মরে বাঁচতে চান। কূপে ফেলার আগে তিনি তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা জানান। তিনি জল খেতে চান। কিন্তু ভাড়াটে লোক দুটি একজন মানুষ মারতে এত সময় দিতে চান না। তাঁরা বলেন, ‘কূপের ভেতরে অনেক জল আছে, খেতে খেতে তৃপ্তির সাথে মরতে পারবেন।’

 বুদেরামের কূপে পড়া নাটকে ঘটনার অভিনবত্ব আর বিপন্ন মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ব্যবসা ফাঁদার মনোবৃত্তি—এ দুটো জিনিসই দর্শকের বোধে চরমভাবে ধাক্কা দেয়। নাটকজুড়েই শ্লেষাত্মক সংলাপ একদিকে দর্শকে হাসিয়েছে, অপরদিকে মানুষের নির্মমতা মনটাকে বিষণ্ন করে তুলেছে। এই নান্দনিক উপস্থাপনা থেকে দর্শক একমুহূর্তের জন্যও ঘাড় ফেরাতে পারেননি। কাহিনির বাঁকে বাঁকে বাঁধা পড়েছে দৃষ্টি। বুদেরাম শেষ পর্যন্ত বাঁচতে চাইলেন। কিন্তু এখানে কারও ভালো যে কারও সহ্য হয় না! বাঙালির চিরপরশ্রীকাতরতার কবল থেকে বুদেরাম বাঁচতে পারেন না। আজকের বখে যাওয়া তরুণেরা তাঁকে হায়েনার মতো আক্রমণ করেন। কেন করছেন, তার কারণ তাদের জানা নেই। বলতে পারে না। কারণ খুঁজতে তাঁরা মাদক সেবন করে। শেষ পর্যন্ত টালমাটাল হয়ে বুদের নামের সঙ্গে রাম শব্দ থাকার কারণে ধর্মের অবমাননার অভিযোগ তোলে। তাঁরা আবার বুদেরামকে সেই কূপেই ফেলে দেন। যখন বুদেরাম আর্তচিত্কারে জানিয়ে দেন, ওই কূপে জল নেই। আছে শুধু জঞ্জাল, সেখানে কেউ মরতে পারে না, তখন মঞ্চের কূপটাকেই মনে হয়, বর্তমান বিশ্বটাই একটা বিবেকহীন নরককূপ।

৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ও ৫ ফেব্রুয়ারি নাটকটির তৃতীয় প্রদর্শনী হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক প্রথম প্রদর্শনীতে নাটকটি দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। গত ১৩ জানুয়ারি এই নাটকের দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয়েছে কলকাতায় ‘রঙের হাট আন্তর্জাতিক নাট্যোত্সব’–এর উদ্বোধনী দিনে। নাটকটির সংগীত পরিকল্পনায় ছিলেন শৌভিক রায়, কোরিওগ্রাফি করেছেন ল্যাডলী মোহন মৈত্র, মঞ্চ পরিকল্পনায় কনক কুমার পাঠক ও মনির উদ্দিন। আলোক পরিকল্পনায় আল জাবির এবং প্রযোজনা আধিকারিক ছিলেন এস এম আবু বকর।