ফাগুন হাওয়ায় ভালোবাসায়

তিশা ও সিয়াম। ছবি: কবির েহাসেন
তিশা ও সিয়াম। ছবি: কবির েহাসেন
>

গল্পটা ভাষার। গল্পটা ভালোবাসার। প্রেমের। এমন গল্প নিয়েই তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেছেন নতুন চলচ্চিত্র ফাগুন হাওয়ায় আগামীকাল দেশের ৫২টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে ছবিটি। ছবির নানা ধরনের বিষয় নিয়ে কথা হলো নির্মাতা তৌকীর আহমেদ, অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা এবং অভিনেতা সিয়াম আহমেদের সঙ্গে।

গল্পটা প্রেমের। পরিচালকের কাছ থেকে এমন তথ্য নিয়ে আগ্রহ বাড়ে। সেই শুটিং থেকে শুরু করে এখন অব্দি সংবাদকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানেন, ফাগুন হাওয়ায় চলচ্চিত্রটি ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত। সেটা যে প্রেমেরও, এটা জানা গেল দু-তিন দিন আগে। গত মঙ্গলবারের আড্ডায় বসে এই ছবির অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা খোলাসা করলেন একটু, বাকিটুকু সিয়াম আহমেদ। তিশা বললেন, ‘ছবিতে আমি একজন মফস্বলের মেয়ে। এলাকার তরুণেরা মিলে একটা নাটক মঞ্চস্থ করতে চাই। সেটা ধরেই এগিয়ে যায় আমাদের মিষ্টি প্রেমের গল্প।’

সিনেমার মধ্যে অভিনয় করা নাটকের নাম বললেন সিয়াম। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ

িশা আবার কথা শুরু করেন। ‘মফস্বলের এই মেয়েটা খুব সাধারণ। আসলে ২০১৯-এ একটা মেয়ে যেভাবে কথা বলবে, ১৯৭১-এ সেভাবে বলবে না। একইভাবে ১৯৫২ সালেও সেভাবে বলবে না। তার হাসি ভিন্ন থাকবে, চাহনি ভিন্ন থাকবে। এমনকি তরুণ-তরুণীদের আন্তসম্পর্কও এখনকার মতো থাকবে না। সব মিলিয়ে আমাদের প্রেমের প্রকাশটাও ভিন্ন ছিল। তবে এত কিছু সম্ভব হয়েছে একমাত্র পরিচালকের কল্যাণে।’

এবার সিয়াম কথা টেনে নেন, ‘আমার মনে হয়, এই সময়ের তরুণ হয়ে এ রকম একটা ইতিহাসনির্ভর চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকা বা জড়িত হতে পারা আনন্দের। ফাগুন হাওয়ায়-এরচিত্রনাট্য পছন্দ করার সবচেয়ে বড় কারণ, এটা ভাষা আন্দোলনের ঘটনাকে ছুঁয়ে যাওয়া চিত্রনাট্য। এটা এমন একটা ঘটনা, যেটা আমাদের জাতীয় এবং ব্যক্তিগত জীবনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। অভিনয় করে নিজের জাতীয়তাবোধটা জানাতে পেরেছি। এ ধরনের ছবিতে অভিনয়ের জন্য আমাদের মতো শিল্পীদের একটা ক্ষুধা সব সময়ই থাকে। সেই ক্ষুধাটা আমরা মিটিয়েছি। এটা ব্যবসায়িকভাবে সফল কি ব্যর্থ হলো, তার চেয়েও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এমন একটা ছবিতে আমি অভিনয় করতে পারলাম, সেটা।’

নতুন জুটি সিয়াম-তিশা
আড্ডায় বসে সিয়াম ও তিশা কখনো আপনি করে বলছেন, কখনো তুমি কখনো তুই? রহস্যটা কী? একবার তো সিয়াম ‘আপনি’ বলে ফেলায় হেসেই ফেললেন তিশা। দুজনের রসায়নটা কী? জানালেন, রসায়নটা একদম সিনেমার মতো। সিনেমায় যেমন একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প আছে, আমাদের মধ্যে সম্পর্কটাও ওরকম মিষ্টি।’

সিয়াম যেন এককাঠি সরেস। বললেন, ‘আমাকে দেখেই তিশা বললেন, আমার শার্টটা নাকি ফারুকী (তিশার স্বামী মোস্তফা সরয়ার ফারকী) ভাইয়ের একটা শার্টের মতো। সেটা নাকি আবার ফারুকী ভাইয়ের খুব পছন্দ। তাহলে বোঝেন আমাদের কেমন সম্পর্ক?’

তিশা ও সিয়াম এর আগে একটি দুটি নাটকে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সিনেমায় এই প্রথম। একটানা ২২ দিন শুটিং করেছেন ঢাকার বাইরে। থেকেছেন বন্ধুর মতোই। তিশা বললেন, ‘আমরা ভালো বন্ধু। সেটা আরও গাঢ় হয়েছে ফাগুন হাওয়ায় করতে গিয়ে। এই বন্ধুত্বটা আরও মজবুত হবে সিনেমাটা হিট হলে।

তবে সম্পর্ক যা-ই হোক, ফাগুন হাওয়ায় চরিত্র দুটিতে ঢুকতে দুজনকে কষ্ট কম করতে হয়নি। সবচেয়ে বড় যেটা জরুরি ছিল সেটা হলো সময়টা ধরা। তিশা বললেন, ‘সিনেমায় আমরা যে নাটকটা করেছি সেটাই এত ঘটনাবহুল যে দর্শককে অনেক কিছুই বলে দেবে। এর মধ্যে অনেক প্রপস ও ঘটনা আছে, যেটা দেখে দর্শকেরা সহজেই অনেক কিছু বুঝে যাবেন।’

সিয়ামও একমত হলেন, ‘ভালোবাসা দিবসের পরের দিন ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে। আমাদের মতো করে ভাষাকে কে ভালোবাসতে পেরেছে। এই ভালোবাসার জোরেই তো এটা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই ছবিতে ভাষা এবং ভালোবাসা পাশাপাশি হেঁটেছে। অনেকটা হাত ধরাধরি করে।’

সিয়ামের ভাষায়, এই সময়ের অভিনেত্রী হিসেবে নুসরাত ইমরোজ তিশা একটা ব্র্যান্ড। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের দুজনের দারুণ বোঝাপড়া রয়েছে। হয়তো পরের সিনেমায় আবার আমরা একসঙ্গে অভিনয় করব। মোটকথা, তিশার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।’

সিয়াম সম্পর্কে দারুণ মূল্যায়ন তিশার। ‘এই সময়ের তরুণদের মধ্যে বেশ ভালো ভালো কাজ করছে সিয়াম। ওর দুটো ছবিই তো হিট। আশা করছি এটাও হিট হবে। কারণ, ছবির নামটি এখন সবার কাছে পৌঁছে গেছে। এখন শুধু হলে আসার অপেক্ষা।’

আলাপচারিতায় পরিচালক ও শিল্পীরা। তিশা,  তৌকীর আহমেদ ও সিয়াম
আলাপচারিতায় পরিচালক ও শিল্পীরা। তিশা, তৌকীর আহমেদ ও সিয়াম


সিনেমা নির্মাণ একটা যুদ্ধ
তৌকীর আহমেদ, নির্মাতা, ফাগুন হাওয়ায়

২০০৪ সালের দিকে হাফিজুর রহমানের লেখা ‘বউ কথা কও’ নামে একটি গল্প পড়েছিলেন তৌকীর আহমেদ। তখন থেকেই পরিকল্পনা করেছিলেন, এ ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। দুই পাতার গল্পের মূল ভাষ্য ছিল, একটা পাকিস্তানি পুলিশ অফিসার একটা মফস্বলে পোস্টিং পায়। তারপর থেকে সে নানা ধরনের অযৌক্তিক কর্মকাণ্ড করতে থাকে। সেটা পড়েই চিত্রনাট্য রচনা করেন তৌকীর। চান অনুদানও। কিন্তু পাননি। কিন্তু দমে যাননি। চিত্রনাট্য সংযোজন-বিয়োজন করতে থাকেন। সবশেষে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের সঙ্গে আলাপ করে নির্মাণে হাত দেন।

তৌকীর আহমেদের কাছেই প্রশ্নটা করি, এই সিনেমা বানাতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন? প্রশ্ন শুনে একটু ভাবেন তিনি। বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এ ধরনের সিনেমায় কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। সবাই ভাবে, এটা একটা লস প্রজেক্ট। ইমপ্রেসকে ধন্যবাদ আমাকে শেষ অবধি সাহস দিয়ে পাশে থাকার জন্য। আমি শুধু বলতে চাই, ২১ ফেব্রুয়ারির কোনো তথ্যচিত্র নির্মাণ করিনি, কোনো ইতিহাসও রচনা করতে যাইনি। আমি শুধু ওই সময়ের একটা ঘটনা দিয়ে একুশের চেতনাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেছি। যেখানে প্রেম আছে। চেতনা আছে। একটা মিষ্টি গল্প আছে। আর পুরো ঘটনাটাই আমরা হাস্যরসাত্মকভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।’

গত সোমবার তৌকীর আহমেদের মহাখালী ডিওএইচএসের অফিসে বসে এই আলাপের সময় সামনে চা চলে আসে। সেটাতে চুমুক দিয়ে তৌকীর বলেন, ‘সবচেয়ে যেটা বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল সেটা হলো ৬৬ বছর আগের বাংলাদেশের ওই সময়টাকে পুনর্নির্মাণ। সেটা খুবই কঠিন কাজ ছিল। উদাহরণ দিই, আমার যদি একটা গাড়ি বা মোটরসাইকেল লাগে, সেটা ১৯৫২ সালের হতে হবে। টাইপরাইটার বা রেডিও সবই ওই সময়ের হতে হবে। এমনকি রাস্তাঘাট, নৌকা, পোশাক—সবই। এটা যে কতটা কঠিন ছিল, সেটা দর্শকেরা না দেখলে বুঝতে পারবেন না।’

তৌকীর জানালেন, একটা পুরোনো রেডিও কিনতেই খরচ করতে হয়েছে ২০ হাজার টাকা। এ রকম প্রতিটি পুরোনো জিনিসই ছিল ব্যয়সাপেক্ষ। একই সঙ্গে থ্রি নট থ্রি রাইফেলের জন্য পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন তিনি।

এত কিছু করতে গিয়ে একটা যুদ্ধই করেছেন তৌকীর আহমেদ। বললেন, ‘এত কিছু করেছি শুধু একটা ভালো সিনেমা বানানোর জন্য। আমার বিশ্বাস, এটা দেখতে এই সময়ের তরুণদের খারাপ লাগবে না। বরং তাঁরা বিনোদন পাবেন। একই সঙ্গে দেশপ্রেম ও বিশেষ করে ভাষার জন্য নতুন করে চেতনা তৈরি হবে। যেটাই আসলে তরুণদের জন্য জাগিয়ে তোলা ও ধারণ করা জরুরি।’