ইতিহাস নারী ভাষাসৈনিকদের কথা বলেনি

‘থ্রু হার আইজ’ আয়োজনে সামিয়া জামান ও শবনম ফেরদৌসি
‘থ্রু হার আইজ’ আয়োজনে সামিয়া জামান ও শবনম ফেরদৌসি

ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের (আইএফআইবি) উদ্যোগে এবং জার্মান কালচারাল সেন্টারের সহযোগিতায় ‘থ্রু হার আইজ’ নারী নির্মাতাদের জন্য একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম। এই মিলনমেলায় প্রতি মাসের তৃতীয় রোববার একজন নারী নির্মাতার চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও উপস্থিত দর্শকদের সঙ্গে আলোচনা হয়। এবারের আয়োজনটি ছিল একটু অন্য রকম। কারণ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাসের মিলনমেলায় কথা হয় নারী ভাষাসৈনিকদের নিয়ে। অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয় শবনম ফেরদৌসি নির্মিত দুটি প্রামাণ্যচিত্র ভাষাজয়িতা ও একটুখানি প্রাণের খোঁজে ।

চলচ্চিত্রকর্মীদের মিলনমেলা
মিলনায়তনে ঢুকতেই চোখে পড়ল নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিম, প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, সদ্য বার্লিনালে ট্যালেন্ট ক্যাম্পাস থেকে ফেরা নির্মাতা হুমাইরা বিলকিসসহ আরও অনেককে। তাঁদের দেখেই এই আয়োজনের অন্যতম আয়োজক সামিয়া জামান উপস্থাপনার একপর্যায়ে বললেন, ‘আজ তো আমরা ভিআইপি দর্শক পেয়েছি।’

ভাষাজয়িতা
আন্তর্জাতিকভাবে মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি মিললেও ইতিহাসের আড়ালে রয়ে গেছে ভাষা আন্দোলনে নারীর ভূমিকা। প্রামাণ্যচিত্র ভাষাজয়িতা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সক্রিয় নারীদের ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস। রওশন আরা বাচ্চু, ড. হালিমা খাতুন, ড. সুফিয়া আহমেদ, সোফিয়া খান, রাণী ভট্টাচার্য ও প্রতিভা মুৎসুদ্দি—এই ছয় ভাষাসৈনিকের সংগ্রামের গল্প উঠে এসেছে প্রামাণ্যচিত্রটিতে, পুরুষতান্ত্রিক ইতিহাসে যাঁদের নাম প্রায় অনুচ্চারিতই থেকে গেছে। সেই নারীদের নিয়েই শবনম ফেরদৌসি তৈরি করেছেন ভাষাজয়িতা।

একটুখানি প্রাণের খোঁজে
একটুখানি প্রাণের খোঁজে প্রামাণ্যচিত্রটি আলোকচিত্রী মাসুমা প্রিয়াকে নিয়ে, যিনি তাঁর সমস্ত জীবন শত উপেক্ষা তুচ্ছ করে ছুটেছেন স্বপ্নের পেছনে। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান সম্পর্কে তাঁর চাচা হন। প্রথম আলোকচিত্র প্রদর্শনী থেকে িপ্রয়ার আয় হয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা! তাঁর কাছের মানুষের মতে, িপ্রয়া আর্থিক কষ্টে ছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর মন, মানসিকতা আর শিল্পীসত্তাকে সব সময় উঁচুতে রাখতে পেরেছিলেন। চিরকুমারী এই শিল্পীর বন্ধুরা তাঁকে কখনোই একা বোধ করতে দেননি। স্বাধীনতাপ্রিয় প্রিয়ার রয়েছে ক্যামেরায় শিল্পকে বন্দী করার অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর দিন শেষে ঘরের কোণে একটুখানি ‘ব্রিদিং স্পেস’, যা তাঁকে সুখী করেছে।

আন্দোলন করতে গিয়ে
নারায়ণগঞ্জ মরগান গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা মমতাজ বেগম ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে চাকরি হারান, জেলে যান। জেল থেকে বের হওয়ার পর তাঁর স্বামী তাঁকে তালাক দেন। এমনকি তিনি তাঁর একমাত্র কন্যাসন্তানকেও নিজের কাছে রাখতে পারেননি। এভাবেই একদিন তাঁর মৃত্যু হয়। ভাষা আন্দোলনে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা-ই নয়, বরং যোগ দিয়েছিলেন অসংখ্য স্কুলের শিক্ষার্থীরাও। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ‘অপরাধে’ এক মেয়ের চুল কেটে দেওয়া হয়, তবু সে পরদিন আবার আন্দোলনে যোগ দেয়। প্রতিভা মুৎসুদ্দির বাবা তাঁকে মারধর করেন। মার খেয়ে প্রতিভা একটুও কাঁদেননি, বরং নিজেকে বলেছেন, ‘আন্দোলন করতে গেলে এটুকু মার খেতেই হয়।’ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ভাষাজয়িতার প্রদর্শনীতে এই গল্পগুলোই দর্শক জানতে পারেন।
এ ছাড়া আন্দোলনের সময় নারীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগাড় করেছেন। সব শ্রেণির মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনের অর্থ জুগিয়েছেন। এমনকি, একটা বাচ্চা ছেলের কাছে একটিমাত্র পয়সা ছিল, সেও সেটি দান করেছিল।

প্রামাণ্যচিত্রও কি চলচ্চিত্র?
‘থ্রু হার আইজ’ আয়োজনে দর্শক সরাসরি নির্মাতার সঙ্গে আলাপচারিতার সুযোগ পান। কথায় কথায় নির্মাতা শবনম ফেরদৌসি জানান, বেশির ভাগ মানুষ প্রামাণ্যচিত্রকে চলচ্চিত্রই মনে করেন না। অনেকেই নাকি তাঁকে বলেন, ‘অনেক তো হলো, এবার একটা সিনেমা (ফিকশন ফিল্ম) বানাও!’ অথচ প্রামাণ্যচিত্র অত্যন্ত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
আয়োজনের শেষে সবাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে প্রামাণ্যচিত্রকে জনপ্রিয় করে তোলা খুবই জরুরি, নয়তো বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে সামনে এগোনো সম্ভব হবে না।