পাংশা থেকে মিসর

>
নুর ইমরান মিঠু ছবি: আশরাফুল আলম
নুর ইমরান মিঠু ছবি: আশরাফুল আলম
গত বছর ঈদে মুক্তি পেয়েছে নুর ইমরান মিঠু পরিচালিত প্রথম ও একমাত্র সিনেমা কমলা রকেট। মুক্তির পর প্রেক্ষাগৃহে চলেছে কিছুদিন। এরপর দেশে ও দেশের বাইরে বেশ কিছু উৎসবে অংশ নিয়েছে। পুরস্কার জমেছে ঝুলিতে। কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের দুটি ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত কমলা রকেট–এর পরিচালক আরও একটি উৎসবে যোগ দিতে যাচ্ছেন মিসরে। কমলা রকেট–এর বিদেশযাত্রা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন হাবিবুল্লাহ সিদ্দিক

কথার এক ফাঁকে মিঠুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার বাবা কী করেন?’ মিঠু একমুহূর্ত সময় অপচয় না করে বললেন, ‘আমার বাবা একজন কবি। তাঁর নিজের একটা পত্রিকা আছে। সাহিত্য পত্রিকা। প্রতি তিন মাস পরপর বের হয়। ওটার লেখা সংগ্রহ, সম্পাদনা, ছাপানো, পত্রিকা বিক্রি বাবা একাই করেন।’ বাহ্‌, চমৎকার। কবি বাবার নির্মাতা পুত্র। দুজনই সৃজনশীল পেশা বেছে িনয়েছেন।

রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার আলো–বাতাসে বেড়ে ওঠা মিঠু গুছিয়ে বলেন। ‘আমি যখন ক্লাস সেভেন পড়ি, তখন গ্রামের সিনেমা হলে জসীম, রুবেল, মাহমুদ কলিসহ অনেকের সিনেমা চলত। ওই সময় ওগুলো দেখতে দেখতেই মনে হতো এটা তো আরেকটা জীবন। কী সুন্দর, কী সুন্দর! তখনই মনে হয়েছে আমি জীবনে আর কিছু না হতে পারলেও ওই জীবনটা দেখব। উপভোগ করব। এ কারণেই নির্মাণে আসা।’

এই ফাঁকে নিজের সিনেমা দেখার সময়ের একটা গল্প বলেন মিঠু। পাংশা থানার পাশেই মৃগী নামে একটা জায়গা আছে। সেখানে ছিল মিঠুর মামাবাড়ি। আর ছিল অনামিকা নামের একটা কাঠের তৈরি সিনেমা হল। চারপাশে কাঠ হওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় ফুটো ছিল। সেই ফুটোতে চোখ রাখতেন মিঠু ও তাঁর মামাতো ভাইয়েরা। কিন্তু সেখানেও ঘটত অদ্ভুত ঘটনা। মিঠু বলেন, ‘এলাকার পোলাপান ফুটো দিয়ে মাগনা সিনেমা দেখত বলে হলের মালিক ও কর্মচারীরা ফুটোর মুখে কাঠি দিয়ে গোল করে করে ময়লা লাগিয়ে রাখত। ফুটোয় কেউ চোখ রাখলেই সেটা লাগত চোখে। কী যে একটা বিচ্ছিরি অবস্থা হতো তখন। কিন্তু এসবে আমাদের সিনেমা দেখার আগ্রহ দমিয়ে রাখতে পারত না।’

কৈশোরের পুরোটা সময় এভাবেই কেটেছে মিঠুর। গ্রাম, কাঁচা পথ, খেত, খাল–বিল-নদী—এসবের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন তিনি। এ কারণেই কিনা কে জানে, প্রথম ছবি কমলা রকেট–এর প্রতিটি মুহূর্তেই চলে এসেছে প্রকৃতি। মিঠুর ভাষায়, ‘পুরো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি আমার কমলা রকেট।’

জানতে চাই, ছোটবেলায় সিনেমা দেখলে বেশির ভাগ কিশোর নায়ক হতে চায়। আপনি হতে চেয়েছেন নির্মাতা। কারণ কী? এবার লাজুক হাসি দেন, ‘আমার ওই সময়ই মনে হয়েছে, আমি খুব লাজুক। চাইলেও নায়ক হতে পারব না। তাই ক্যামেরার পেছনটাই আমার পছন্দ ছিল বরাবর।’ কিন্তু না, মিঠু নায়ক হয়েছিলেন একবার। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পিঁপড়াবিদ্যা চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে চিনিয়েছেন। নিজেকে চেনালে কী হবে, মিঠু পুরো কৃতিত্ব দিলেন নির্মাতা ফারুকীকে।

এরপর মিঠুর গল্পটা ছড়িয়েছে শুধু। এসএসসি পাস করেছেন পাংশা জজ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে। তারপর পাংশার পাশেই কসবাতে ফুফুর বাসায় চলে যান। সেখানে কসবা মাজাইল ডিগ্রি কলেজ থেকে পাস করেন এইচএসসি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম বছর কোথাও জায়গা হয় না তাঁর। পরের বছর ভর্তি হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু টিকেছিলেন আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু খুলনায় ভর্তি হওয়ার বিশেষ দুটি কারণ আছে।

জানালেন, পাংশা থেকে খুলনা একটা ট্রেন যাতায়াত করে। প্রায় সাত-আট ঘণ্টা সময় লাগে যেতে। এই ট্রেনে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের লোভে আমি খুলনায় ভর্তি হই। আরও একটা কারণ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনের পাঁচ বছর সুন্দরবনের ওপর একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শেষতক আর উপন্যাস লেখা হয়নি আমার।’

তবে উপন্যাস লেখা না হোক, উপন্যাসের চরিত্রের মতো সত্যি সত্যি দেশের প্রতিটি থানায় ঘুরেছেন তিনি। থেকেছেন নানা প্রান্তে। মিশেছেন মানুষের সঙ্গে। জানালেন, দেশের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে তিনি যাননি।

তাই গল্পে সবার আগে আসে মানুষ। যে মানুষদের নিয়েই তাঁর প্রথম সিনেমা কমলা রকেট। যে রকেট ঘুরেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। বয়ে নিয়ে এসেছে পুরস্কারও। মিঠু হাতের কর গুনেই পুরস্কারের হিসাব দেন। শ্রীলঙ্কার জাফনা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পেয়েছে বেস্ট ডেব্যু ফিল্মের পুরস্কার। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ‘ফেস্টিভ্যাল দ্যু ফিল্ম দ্য এশিয়া’ জুরি প্রাইজ জিতেছে। এ ছাড়া দেশের আয়োজিত ‘আমার ভাষা চলচ্চিত্র উৎসবে’ হীরালাল সেন পদক পেয়েছে সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে। এ ছাড়া অংশ নিয়েছে ভারতের গোয়া, মুম্বাই, চেন্নাইয়ের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। এমনকি নেপাল ও ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখা গেছে ছবিটি। আর সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী সপ্তাহের শুরুতেই কমলা রকেট নিয়ে মিঠু যাচ্ছেন মিসরের শারম আল শেখ এশিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে।

বলে রাখা ভালো, দেশের যে তিনটি চলচ্চিত্র নেটফ্লিক্সে দেখা যায় তাঁর মধ্যে মিঠুর কমলা রকেটও রয়েছে।