থিয়েটার কেন দাঁড়াচ্ছে না?

‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নাটকের অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে সৈয়দ জামিল আহমেদ
‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নাটকের অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে সৈয়দ জামিল আহমেদ

দাঁড়াতেই পারছে না বাংলাদেশের থিয়েটার। মঞ্চের প্রসঙ্গে উঠলেই বারবার উঠে আসে গত শতকের সত্তর বা আশির দশকের কয়েকটি নাটকের নাম। থিয়েটার বা মঞ্চনাটকের সমস্যা নিয়ে এবার মুখ খুললেন বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক নাট্যশিক্ষার পথিকৃৎ সৈয়দ জামিল আহমেদ। বাংলাদেশে পেশাদার থিয়েটার গড়ে না ওঠার নানা কারণ বিশ্লেষণ করেছেন এই নাট্যজন। তিনি মনে করেন, একসঙ্গে অনেক কিছু করার আকাঙ্ক্ষার কারণেই বাংলাদেশের থিয়েটার দাঁড়ায়নি।

গতকাল সোমবার দুপুরে ছিল প্রযোজনাভিত্তিক নাট্যসংগঠন ‘স্পর্ধা’র সংবাদ সম্মেলন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে দলটির নতুন প্রযোজনা ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’-এর মঞ্চায়নসহ থিয়েটারের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে নাটক না দাঁড়ানোর অনেকগুলো কারণ আছে। অভিনয়শিল্পীরা নাটক ভালোবাসেন, সেটা করতেও চান। কিন্তু অফিস শেষ করে, যানজট ঠেলে রাত নয়টার সময় ক্লান্ত শরীরে তিনি মহড়ায় আসেন। তাঁর বাড়িতে ফেরার তাড়া থাকে, সংসার সামলাতে হয়। এসব চাপের কারণেই আমরা পারিনি। প্রতিনিয়ত একটু একটু করে ছাড় দিতে দিতে মঞ্চনাটক আজকের এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।’

আক্ষেপ করে সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, ‘আমরা যদি পেশাদার অবস্থানটা ঠিক রাখতে পারতাম, তাহলে লোকে আমাদের নাটক দেখতে আসত। সত্তর বা আশির দশকে দেখত। তখনকার চর্চাটা এখন নেই। পেশাদার কণ্ঠশিল্পী বা নৃত্যশিল্পীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে নিয়ম করে তিন-চার ঘণ্টা রেওয়াজ ও চর্চা করেন। আমাদের থিয়েটারকর্মীদের সেই সময় নেই।’

তবে কি বাংলাদেশে সফল ও সার্থক থিয়েটার করা সম্ভব নয়? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, ‘সম্ভব। যদি অন্তত সাতজনের একটি দল গড়া যায়, তাঁদের যদি বিশ-পঁচিশ হাজার টাকায় মাস চলে। তাঁদের যদি টেলিভিশনে অভিনয় করতে যাওয়ার চাহিদা না থাকে। দলটিকে নিয়ে সারা দেশে ট্যুর করা যায়, তাহলেই সম্ভব।’ স্পর্ধার কয়েকজন অভিনেতার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক শিল্পীই ফুলটাইম নাটক করতে চায়। কিন্তু ফুলটাইম মঞ্চে কাজ করে ঢাকা শহরে চলার মতো টাকা আয় করা যায়? টেলিভিশনে করা যায়, থিয়েটারে যায় না।’

‘স্পর্ধা’ দলটির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা একটি পেশাদার দল গড়তে চেয়েছি। কয়েকজন অভিনেতাকে কর্মশালা করিয়ে একটি নাটক একটানা প্রদর্শনী করে শেষ করে ফেলব। পরে আবার নতুন কোনো নাটক নিয়ে কাজ করব। “জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা” থেকে প্রাপ্ত আয় থেকে এই অভিনেতাদের সম্মানী দেওয়া হবে।’

রেপার্টরি থিয়েটার প্রসঙ্গে সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, ‘স্পর্ধা রেপার্টরি থিয়েটার নয়। রেপার্টরি থিয়েটার নিয়ে আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। রেপার্টরি থিয়েটার মানেই তাদের নিজেদের একটি হল থাকবে। দুই বা এক বছরের চুক্তিতে তাঁরা অভিনেতাদের নিয়োগ দেবেন। বাড়ি থেকে পরিচালককে ডেকে এনে নাটক পরিচালনা করাবেন। তারপর দুই বা তিনটি নাটক সারা বছর ধরে প্রদর্শনী করতে থাকবে। আমাদের এখানে সেই অর্থে কোনো রেপার্টরি কোম্পানি তৈরি হয়নি।’

প্রয়াত ঔপন্যাসিক শহীদুল জহিরের উপন্যাস থেকে নাটক তৈরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শহীদুল জহির মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, সেটা আমার ভেতরে দাগ কেটেছে। এ রকম দাগ খুব কম উপন্যাস বা নাটক ফেলতে পেরেছে। এ নাটক মঞ্চে আনার উদ্দেশ্য একটাই। যুদ্ধটা কেমন ছিল, যুদ্ধবিরোধীরা যুদ্ধ শেষে কীভাবে পুনর্বাসিত হয়েছিল, সেটার প্রতিরূপায়ন লেখক কত তীক্ষ্ণভাবে করেছেন, সেটাই দেখানো। আমাদের ৪৮তম স্বাধীনতাবার্ষিকী সেটার জন্য উপযুক্ত সময়। এর মধ্য দিয়ে একাত্তরের স্বাধীনতায় শহীদদের প্রতি, শেখ মুজিবের প্রতি, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো যাবে। এ ছাড়া ১৭ মার্চ শেখ মুজিবের ৯৯তম জন্মবার্ষিকীর দিনের প্রদর্শনীটি তাঁকে উৎসর্গ করা হবে।’

‘মুক্তিযুদ্ধ নাট্য উৎসব ২০১৯’ উপলক্ষে ১৪ থেকে ২০ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নাটকের প্রদর্শনী হবে। প্রতিদিন একই সময়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হবে নাটকটি। এ ছাড়া ১৫ থেকে ১৭ ও ২০ মার্চ বেলা সাড়ে তিনটায় থাকবে আরও চারটি প্রদর্শনী। দুই ঘণ্টার এ নাটকে অভিনয় করেছেন ২০ জন শিল্পী। দলটির উপদেষ্টা সৈয়দ জামিল আহমেদ। নাটকের অগ্রিম টিকিট মিলবে অনলাইনে। দাম পড়বে ১০০০, ৫০০, ৩০০ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ টাকা।