ঘটনাবহুল মার্চ মঞ্চে-ইতিহাসে

লাল জমিন নাটকে মোমেনা চৌধুরী
লাল জমিন নাটকে মোমেনা চৌধুরী

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাঙালিকে এই উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৬ মার্চ বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য। সেই থেকে বাঙালির ইতিহাসে মার্চ মাস সন্নিবেশিত হয়ে আছে এক বিশেষ মাস হিসেবে। মার্চ যেমন আমাদের স্বাধীনতার মাস, তেমনি আমাদের মুক্তির মাস, আমাদের অর্জনের মাস। স্বাধীনতা এসেছে বলেই আমাদের জাতীয় জীবনের বদ্ধ সব আগল মুক্ত হয়েছে। ১৯৭২ সালে মুক্ত পরিবেশে আমরা পা ফেলেছিলাম নতুন পথে, সমৃদ্ধির পথে, অর্জনের পথে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্ত পরিবেশে দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র-জনগণ মেতে উঠেছিল নতুন ভাবনায়, নতুন সৃজনে। ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর নাটক কবর, মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় সফল মঞ্চায়নের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল আমাদের নবনাট্য আন্দোলন। ৪৭ বছরের পথপরিক্রমায় সেই নাট্যান্দোলন আজ পুষ্পপত্র-পল্লবে বিকশিত হয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে, সৌরভ ছড়াচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশে আমাদের নাটক পৌঁছে গেছে, সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়েছে। মঞ্চনাটকে আমাদের যা অর্জন, তা স্বাধীনতা-মুক্তিরই সুফল। আমাদের নাটকের নানা অর্জনের কথা আজ আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি। ইতিহাসের ঘটনাবহুল মার্চ মাসেই এ বছর নানাবিধ অর্জনে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের নাট্যাঙ্গন, যা নব নাট্যান্দোলনে ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমাদের মঞ্চনাটককে নতুন পথ দেখাবে। এবারের মার্চ মাসের কিছু নাট্য ঘটনা টুকে রাখা দরকার আগামী দিনের নাট্য ইতিহাস রচনার প্রয়োজনে। কী কী ঘটনা এই মার্চ মাসে ঘটল, যা আমাদের নাট্য ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে চলছে? চলুন একবার জেনে নিই সেই ঘটনাগুলো—

এক নাটকের ১০ দিনে ১৫ প্রদর্শনী

প্রযোজনাভিত্তিক নাট্যসংগঠন ‘স্পর্ধা’ তাদের নাটক জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে এ মার্চ মাসেই আয়োজন করে স্বাধীনতা উত্সব। শহীদুল জহিরের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা মঞ্চে উপস্থাপিত হয় সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায়। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয় ১৪ মার্চ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায়। টানা ২০ মার্চ পর্যন্ত প্রতি সন্ধ্যায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ছুটির দিনগুলোতে বেলা সাড়ে তিনটায় একটি করে বাড়তি প্রদর্শনী হয়। দুই দিন বিরতি দিয়ে আবার ২৩ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত তিন দিনে আরও চারটি প্রদর্শনী হয়। এক মাসে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মোট ১৫টি প্রদর্শনী হয়। বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে এটি একটি রেকর্ড। এ নাটকটি নানাভাবে আলোচনায় এসে দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে মার্চ মাসজুড়ে। নাটকটি নিয়ে যেভাবে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছিল, তা সম্ভবত অন্য কোনো নাটকের ভাগ্যে জোটেনি এ পর্যন্ত।

নারীদের ৮

নারী অভিনয়শিল্পীরা আমাদের মঞ্চকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তাঁদের অভিনয় কুশলতায় একের পর নির্মিত ও প্রদর্শিত হচ্ছে নারী অভিনয়শিল্পীদের একক অভিনয়ের নাটক। ফেরদৌসী মজুমদার কোকিলারা নাটক দিয়ে একক অভিনয়ের যে ধারা নির্মাণ করেছিলেন, সেই ধারা আজ আরও বেগবান হয়েছে। এ সময়ে নারী শিল্পীদের দ্বারা অভিনীত অন্তত গোটা দশেক একক অভিনয়ের নাটকের খবর আমাদের জানা, যেগুলো নিয়মিত প্রদর্শিতও হচ্ছে। তবে গর্ব করার মতো বিষয় এই যে এ মার্চ মাসেই ন্যূনতম আটজন অভিনেত্রীর আটটি একক অভিনয়ের নাটক একাধিক মঞ্চায়ন হয়েছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মঞ্চে। নাটকগুলো হলো, কহে বীরাঙ্গনা (জ্যোতি সিনহা, মণিপুরি থিয়েটার), নভেরা (জামিউন জাহান দোলা, ধ্রুপদ), পঞ্চনারী আখ্যান (রোজি সিদ্দিকী, ঢাকা থিয়েটার) হেলেন কেলার (জুয়েনা শবনম, স্বপ্নদল), বীরাঙ্গনার বয়ান (রওশন জান্নাত রুশনী, শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র), আমার আমি (দীপ্তা রক্ষিত, নান্দীমুখ), একা এক নারী (তনিমা হামিদ, নাট্যচক্র, ২৩ মার্চ উদ্বোধনী মঞ্চায়ন), লাল জমিন (মোমেনা চৌধুরী, শূণ্যন রেপার্টরি)।

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নাটকের দৃশ্য
জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নাটকের দৃশ্য

২০০ লাল জমিন

মুক্তিযুদ্ধের ওপর এ সময়ের আলোচিত একক অভিনয়ের নাটক লাল জমিন। মান্নান হীরার লেখা, সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় শূণ্যন রেপার্টরির এই নাটকে একক অভিনয় করে মোমেনা চৌধুরী দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন। এ মার্চ মাসের ১৯ তারিখ অনুষ্ঠিত হলো লাল জমিন-এর ২০০তম মঞ্চায়ন।

৯ কিন্তু সহজ কথা নয়

নানা রকম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদের নাটকের দলগুলো কাজ করে। নাট্যকর্মীরা পেশাদারি মনোভাব নিয়ে কাজ করলেও মঞ্চে পেশাদার হওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও দলগুলো শিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকে নিরলসভাবে নাটক করে যাচ্ছে। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতায় আমাদের মঞ্চে এসেছে নানা রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ অনবদ্য সব নাটক। এ ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রায় নেই বললেই চলে। দলগুলো সারা বছর তাদের নাটকের প্রদর্শনী করে কখনো নিজেদের আয়োজনে, কখনো অন্যের আমন্ত্রণে। দেশের প্রধান সারির নাট্যদল প্রাঙ্গণেমোর এ মার্চ মাসে তাদের চারটি নাটকের নয়টি প্রদর্শনী করে। যার একটি নিজেদের আয়োজনে, বাকি আটটি প্রদর্শনী করে বিভিন্ন উত্সবে বিভিন্ন দলের আয়োজনে, তাও আবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ভাবলেই মনটা কেমন ভালো হয়ে যায়। একটা দল সারা মাস ব্যস্ত ছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নাট্যভ্রমণে, নাট্যপ্রদর্শনে। এটিও আমাদের দেশের নাট্যাঙ্গনের জন্য একটা বড় ঘটনা, বড় অর্জন, এক নতুন রেকর্ড, যা ঘটল এ মার্চ মাসেই।

দীর্ঘদিন ধরে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’

মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ কাব্যনাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। নাটকটি প্রযোজনা করেছে থিয়েটার। ১৯৭৫ সালের ২৫ নভেম্বর নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয়ে। সৈয়দ শামসুল হক রচিত এ নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। একটানা অনেক বছর নাটকটির প্রদর্শনী চলার পরে বন্ধ হয়ে গেলেও ২০০১ সাল থেকে আবার মঞ্চায়ন শুরু হয় পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকটির। পরবর্তীকালে সুদীপ চক্রবর্তীর নব নির্দেশনায় নাটকটি আবার মঞ্চে আসে ২০১১ সালে। মাঝখানে দুবারে কয়েক বছর নাটকটির প্রদর্শনী বন্ধ থাকলেও আমাদের মঞ্চে দীর্ঘদিন ধরে মঞ্চস্থ হওয়া নাটক এটি। সবচেয়ে বেশি দিন ধরে মঞ্চে থাকা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকটির ১৯৫ ও ১৯৬তম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় এ মার্চ মাসে স্বাধীনতা দিবসে।

বিশ্বকে আলিঙ্গন বিশ্বনাট্য দিবসে

প্রতিবারের মতো এবারও ২৭ মার্চ বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে বিশ্বনাট্য দিবস পালিত হলো আমাদের নাট্যাঙ্গনে। ‘বিশ্ব জুড়ে নাট্যজন, এক সুর এক প্রাণ’ শিরোনামে এবারের আয়োজন নানা দিক থেকে বেশ তাত্পর্যপূর্ণ। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় আয়োজিত বিশ্বনাট্য দিবসে এবার সম্মাননা প্রদান করা হয় প্রয়াত সংস্কৃতিজন নিখিল সেনকে। এবার বিশ্বনাট্য দিবসের স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেন নাট্যজন শিমূল ইউসুফ। অনন্য প্রজ্ঞা, বিশ্লেষণ আর মননশীলতায় জাতীয় নাট্যের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। এবারে বিশ্বনাট্য দিবসে বাণী দেন কিউবার নাট্যকার, নির্দেশক ও নাট্যশিক্ষক কার্লোস কেলড্রান। কেলড্রান তাঁর বাণীতে থিয়েটারের শক্তিতে গোটা বিশ্বকে একত্র করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘থিয়েটার স্বয়ং এক দেশ, এক বিশাল সাম্রাজ্য যা গোটা বিশ্বকে আলিঙ্গন করে।’