চোরাস্রোতে বয় ইসপের উপদেশ

নেটফ্লিক্সে প্রচারিত ধারাবাহিক লাভ, ডেথ প্লাস রোবটস–এর দৃশ্য
নেটফ্লিক্সে প্রচারিত ধারাবাহিক লাভ, ডেথ প্লাস রোবটস–এর দৃশ্য

ধরুন, সভ্যতার চূড়ায় পৌঁছেও মানুষের পিছু ছাড়েনি আদি প্রশ্নগুলো—কে সে, কী তার পরিচয়। ধরুন, পৃথিবী শাসন করছে যান্ত্রিক রোবটরা। ‘নির্বোধ’ মানুষের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক তারা। কেমন লাগবে এমন কিছু দেখতে? কী হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান? শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারবে মানুষ? নেটফ্লিক্সে প্রচারিত ধারাবাহিক লাভ, ডেথ প্লাস রোবটস—এসব প্রশ্নেরই চিত্ররূপ। ডেভিড ফিঞ্চার প্রযোজিত, টিম মিলার পরিচালিত ধারাবাহিকটিতে এখনকার পৃথিবী থেকে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে দেখার অনুভূতি অনেকটা গা শিরশিরে। যেন একটা ঠান্ডা স্রোত পিঠের মাঝ দিয়ে বয়ে যায়।

১৮ পর্বের পুরো ধারাবাহিকটি অ্যানিমেশনে তৈরি। দুর্দান্ত, প্রচণ্ড গতিময় এই অ্যান্থোলজি ধারাবাহিকের প্রতিটি পর্বে আছে অ্যাকশন ও দার্শনিকতার জমাট বুনন, আশা-নিরাশার এক কোমল-কঠিন বিতর্ক। প্রতিটি পর্বের গল্প আলাদা। প্রতিটি গল্পে ইসপের উপদেশ যেন চোরাস্রোতের মতো বয়। যেন বলতে চায়, ‘এই যে ছুটছ অবিরাম, যাবে কোথায়?’

জীবন, মৃত্যু ও ভালোবাসা নিয়ে ধারাবাহিকটির কারবার। এখানে দেখা যাবে, যে ভালোবাসা ও সহানুভূতির অনুভব নিয়ে মানুষের সবচেয়ে বেশি গর্ব, সেটি আর শুধু মানুষের দখলে নেই। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখানো হয়েছে মানুষ, রোবট ও আধা মানুষ-আধা রোবটের মনস্তত্ত্ব আর বিরোধ। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণহীন এক চিত্র দর্শকদের বারবার প্রশ্ন করে—কে শ্রেষ্ঠ? প্রতিটি পর্বে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে সিরিজটি চ্যালেঞ্জ জানায়, মানুষ হিসেবে আমরা পৃথিবীর সঙ্গে যা করছি, তা ঠিক কি নয়।

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও মানুষের মিথস্ক্রিয়ার এক দুর্দান্ত মিশেলে ধারাবাহিকটি সাজানো হয়েছে। প্রতিটি পর্বে আছে নিজস্ব রহস্য। ৫ থেকে ১৫ মিনিটের পর্বগুলোকে অনেকে তুলনা করছেন আশির দশকে সাড়াজাগানো অ্যান্থোলজি ধারাবাহিক (প্রতি পর্বে আলাদা গল্প ও শিল্পী নিয়ে যে ধারাবাহিক এগিয়ে যায়) হেভি মেটাল-এর সঙ্গে।

ঘটনাপ্রবাহ, উত্তেজনা আর গতি—এই তিন হচ্ছে ধারাবাহিকটির প্রাণ। একেকটি পর্বের ঘটনা অনুসরণ করতে করতে দর্শক বুঝতেই পারবেন না যে কখন পর্বটি শেষ হয়ে গেল। তবে মনের গভীর থেকে টের পাওয়া যাবে একধরনের ভয়। মস্তিষ্কে ক্রমাগত বাজতে থাকে, ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’-এর বলি কি তবে এবার মানুষ? মানুষ কি হেরে যাবে নিজেরই সৃষ্টির কাছে? তবে সংশয়ের পাশাপাশি ধারাবাহিকজুড়ে আছে আশাবাদও। যদি ভালোবাসা আর মানবিকতা দিয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়, তাহলে অটুট থাকবে মানুষ আর পৃথিবীর সম্পর্ক। এ ধারাবাহিক আশা-নিরাশার এক কাব্যিক দোলাচল।

ধারাবাহিকের কয়েকটি পর্বে বিখ্যাত সব মাস্টারপিসের প্রতি সম্মান জানানো হয়েছে। যেমন ‘হেল্পিং হ্যান্ড’ পর্বটিতে স্যাটেলাইটের নম্বর থাকে এলভি-৪২৬, যেটি রাইডলি স্কটের বিখ্যাত কাল্ট ক্ল্যাসিক এলিয়েন সিনেমার গ্রহের নাম। একই পর্বে স্ট্যানলি কুবরিকের ২০০১: আ স্পেস ওডিসি ছবির মহাশূন্যে হাড় ছুড়ে মারার সেই বিখ্যাত শটটির কথাও মনে পড়ে যাবে। আবার ‘থ্রি রোবটস’ পর্বে মনে পড়বে টার্মিনেটর সিনেমার পা দিয়ে খুলি গুঁড়িয়ে ফেলার দৃশ্য!

লাভ, ডেথ প্লাস রোবটসকে ৪১ হাজার আইএমডিবি ব্যবহারকারী দিয়েছেন ৮.৮ রেটিং। গত ১৫ মার্চে মুক্তি পাওয়া ধারাবাহিকটি আইএমডিবির (ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেইস) সর্বাধিক রেটিং পাওয়া ধারাবাহিকগুলোর মধ্যে আছে ৬০ নম্বরে। তাই গতিময়, ধুমধাড়াক্কা অ্যাকশন কিন্তু দার্শনিক চিন্তায় ডুবিয়ে ফেলা কোনো কিছু দেখতে চাইলে বসে পড়ুন, নেটফ্লিক্স ছাড়ুন আর হারিয়ে যান লাভ, ডেথ প্লাস রোবটস-এর দারুণ এক ফ্যান্টাসির জগতে!