থেমে গেল অমর পালের গানের তরণি

হীরক রাজার দেশে ছবির রেকর্ডিংয়ে সত্যজিৎ রায় (বাঁয়ে) ও অমর পাল (ডানে)
হীরক রাজার দেশে ছবির রেকর্ডিংয়ে সত্যজিৎ রায় (বাঁয়ে) ও অমর পাল (ডানে)

২০১৪ সালে শীতের একবিকেলে গিয়েছিলাম অমর পালের কলকাতার এম এন নস্কর রোডের বাড়িতে। কত কথা কত গান। আমাদের পেয়ে যেন পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়াকেই হাতে পেলেন। ফেরার বেলা ভাঙা পা নিয়ে এগিয়ে দিতে এলেন বারান্দায়। সেটা ছিল একটা বড় অভিজ্ঞতা। তিনি কথার ভান্ড উজাড় করে দিয়েছিলেন। আর দেখা হবে না লোকগানের কিংবদন্তির সঙ্গে। গত শনিবার (২০ এপ্রিল) ভারতের কলকাতায় এই শিল্পী শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ৯৭ বছর বয়স, দীর্ঘ সময়, তবু চাপা পড়ে গেল আরও একটা বড় অধ্যায়। তাঁর সঙ্গে কাটানো স্মৃতির কিছু টুকরো নিয়েই এই লেখা।

সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে ছবির ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ গানের বদৌলতে অমর পালের কণ্ঠ এ দেশে অনেককেই আপ্লুত করেছিল। অথচ এর আগে তাঁর রেকর্ড হওয়া গানের সংখ্যাও ছিল অনেক। দেশভাগের কিছু আগে ২৬ বছর বয়সে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাট চুকিয়ে তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে এ দেশের অসংখ্য শাখার লোকগান বুকে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রভাতীর সুরবৈচিত্র্য ও প্রাণ নিজের কণ্ঠে করে পৌঁছে দিয়েছেন সবার কানে। নব্বইয়ের দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা সরকারি স্কুলের শতবর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে অমর পাল এসেছিলেন গান গাইতে। যাঁরা সামনাসামনি শুনেছেন, মনে হয়েছিল তাঁর গলার সুরের ভাঁজ খেলানো ঢেউ যেন বুকে এসে আঘাত হানে। ‘শয়নে গৌর স্বপনে গৌর’ এই ভোর কীর্তন তখন থেকে আমাদের সারা দিনের সাথি হয়ে ওঠে। ওই ভোর কীর্তন ছাড়াও ‘আমি স্বপ্ন দেখি মধুমালার মুখ’, ‘মনা কি করলিরে’, ‘চিকন গোয়ালিনী’—এসব গান ছিল সবার মুখে মুখে।

বছর কয়েক আগে আমি এবিসি রেডিও এফএম ৮৯.২–এর পক্ষ থেকে ফোন করি অমর পালকে, একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। প্রায় ২০ মিনিটের একটা টেলিফোন আলোচনা রেকর্ড করি। বাংলাদেশ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া যে তাঁর মনে কীভাবে গেঁথে রয়েছে, সেই বর্ণনাই তিনি দিচ্ছিলেন নানাভাবে। বাড়ির আঙিনায় হওয়া গাজির গান, বেদেদের গান, তিতাসপাড়ের স্মৃতি তিনি বুকে এমনভাবে আগলে রেখেছিলেন, তা শেষ পর্যন্তও ম্লান হয়নি। সেদিন তিনি বেশ কয়েকটা গানও শুনিয়েছিলেন। এবিসি রেডিওর শ্রোতারা বেশ মুগ্ধ হয়ে তা শুনেছিলেন।

বেশ পরে যেদিন তাঁর বাড়িতে গেলাম, দেখি অমর পালের সারা ঘর ভরে আছে বহু পুরস্কার আর সম্মাননায়। তিনি বলতে থাকেন গুরু ওস্তাদ আয়েত আলী খানের কথা। টাউন হলের কাছে গ্রামোফোনে শচীন দেববর্মনের গান শুনেই একদিন মগ্ন হয়েছিলেন গানে। আরেক শচীন, কবিরাজ শচীন ভট্টাচার্য্য, পরবর্তীকালে যাঁর ভরসায় গান শেখার তাড়নায় কলকাতা এসেছিলেন। ওঁরাই জীবনটাকে এদিকে অনেকটা টেনে এনেছেন। মায়ের কথাও অনেক বলতেন অমর পাল। লোকগানের প্রতি তাঁর আগ্রহটা জন্মসূত্রেই। অন্য গায়কেরা যেখানে ভিন্ন সামাজিক অবস্থানে থেকে কারও সংগ্রহের ধন হাতিয়ে নিয়ে কিংবা পটভূমি না জেনেই শুধু গান গেয়ে নিছক প্রাপ্তিযোগের দিকে ঝুঁকেছেন, সেখানে অমর পালকে দেখি এই সংস্কৃতির ভেতরেই তিনি বড় হয়েছেন ‍আপন সংস্কৃতির সক্রিয় বাহক হয়ে। তাই লোকগানের পেছনের গল্পটাও তিনি জানেন। বহু গানের পটভূমি তিনি বলে যেতে থাকেন অবলীলায়।

সময় গড়িয়ে যায়। ‍আমরাও উঠে ‍আসি। কত কথা তাঁর, যেন বলা শেষ হয় না। কানে বাজছিল কত গান।

ওই দেখ বলাই করে শিঙ্গার ধ্বনি

‍আমরা যে শুনিরে... ... ...

ধীরে ধীরে আজ এসে থেমে গেল সেই গানের তরণী