'একটি নক্ষত্রের পতন'

সুবীর নন্দী। ছবি: সংগৃহীত
সুবীর নন্দী। ছবি: সংগৃহীত

অন্ধকার শেষে ঠিক যখনই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল, তখনই সিঙ্গাপুর থেকে খবর এল, বাংলাদেশের বরেণ্য সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী আর নেই। ৬৬ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন। সুবীর নন্দীর এই প্রয়াণে কেউ আত্মার মানুষকে হারিয়েছেন, কেউবা হারিয়েছেন তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং আদর্শ ও অনুপ্রেরণার উৎসকে। হতবাক শিল্পী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও স্মৃতিচারণা করেছেন।

সুবীর নন্দীর প্রয়াণকে নক্ষত্রের পতনের সঙ্গে তুলনা করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত গায়িকা রুনা লায়লা। তিনি লিখেছেন, ‘কিংবদন্তি সুবীর নন্দীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরেকটি নক্ষত্রের পতন হলো। তাঁর গান আগামীর প্রজন্মকে ধারাবাহিকভাবে অনুপ্রাণিত করে যাবে। যেখানে যান না কেন, তিনি এবং তাঁর গান সব সময় আমাদের সঙ্গেই থাকবে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।’

দুই বোন ফাহমিদা নবী ও সামিনা চৌধুরী একসঙ্গে ‘ফেরারি বসন্ত’ নামে একটি সিনেমার গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। গানের কয়েকটি লাইন ছিল এমন ‘আমি কাটার ভুবনে, আলোর পিয়াসি, সুরের আগুনে পুড়ি, এক নতুন পৃথিবী গড়ি।’ ছবিতে বাবা এবং দুই মেয়ের কণ্ঠে ছিল গানটি। ফাহমিদা নবী বলেন, ‘আব্বার গানের ভক্ত ছিলেন সুবীর কাকা, আব্বাকে অনুসরণও করতেন। তাই বাবার ১০টি গান দিয়ে অ্যালবাম তৈরি করেন। সেই তখন থেকে কাকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল বাবা-সন্তানের মতো। মা বলে ডাকতেন। তাঁর একমাত্র সন্তান মৌকে যেমন করে ডাকতেন, তেমনি করে ভালোবাসতেন আমাদেরও। কাকাকে কখনো না বলতে শুনিনি। কিছু আবদার করলে বলতেন, আচ্ছা! আমার উপস্থাপনায় “সুরের আয়না”র প্রথম পর্বে কাকা অতিথি হয়েছিলেন। সেই পর্বে কথার ফাঁকে একটা ইচ্ছার কথা জানতে চেয়েছিলাম। আবেগ ভরা কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, “আমার শেষ ইচ্ছা, আমার মৃত্যুর পর কেউ যেন না কাঁদে, আমি চাই আমার শবদেহের পাশে সবাই যেন আমাকে গান শোনায়।” সংগীতপাগল মানুষটি গান গান করেই সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিলেন! শুধু গান গাইলেই মানুষের মনে জায়গা করা যায় না। বিনয়ী, ধৈর্যশীল, রুচিশীল এবং নিরহংকারী হতে হয়—সুবীর কাকা তা-ই ছিলেন। একজন প্রকৃত শিল্পী। তাই তো আজ তাঁর ভক্তরা কাঁদছেন! কাকা, আপনার গান বাঁচিয়ে রাখবে আপনাকে। সুবীর নন্দী কাকার পরিবারের সঙ্গে আমরাও সমব্যথিত তাঁর এই অকালমৃত্যুতে! অত্যন্ত প্রিয় বিনয়ী শিল্পীর প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করছি। যেখানেই থাকুন, শান্তিতে থাকুন।’


কুমার বিশ্বজিৎ লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ যা হারাল, তা পূরণ হওয়ার নয়। এই মহান শিল্পীর প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা। স্রষ্টা বরেণ্য এই শিল্পীর আত্মাকে শান্তিতে রাখুন।’

সুবীর নন্দীর সঙ্গে মামা-ভাগনের সম্পর্ক ছিল শুভ্র দেবের। তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ মরশীল, ভালোবাসা কভু মরে না, চিতার আগুনে তাই স্মৃতি পুড়ে না। সুবীর মামার স্মৃতি আমরা কোনো দিনও ভুলতে পারব না। তিনি শুধু একজন ভালো শিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন একজন ভালো মানুষ। আমাদের সংগীতাঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।’

মাসখানেক আগেই বাংলাভিশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সুবীর নন্দীর সঙ্গে দেখা হয় চঞ্চল চৌধুরীর। সেই স্মৃতি মনে করে এই অভিনয়শিল্পী লিখেছেন, ‘অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের। কী লিখব সুবীরদাকে নিয়ে? অনেক আবেগতাড়িত হচ্ছি বারবার। চোখটা ভিজে যাচ্ছে। এই তো কয়েক দিন আগে, বাংলাভিশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দাদার সঙ্গে দেখা। দাদার সঙ্গে ছোট ছোট স্মৃতি। দেখা হলেই বলতেন, “কেমন আছ চঞ্চল?” আর কখনো দেখা হবে না সুবীরদার সঙ্গে! হবে না কোনো কথা! এভাবেই আমাদের মাথার ওপর থেকে ছাদগুলো ক্রমশ সরে যাচ্ছে। ক্ষণজন্মা এই শিল্পী সুবীর নন্দীর অভাব পূরণ হওয়ার নয়। আপনি বেঁচে থাকবেন গানে, মনে, প্রাণে—শত সহস্র বছর। ভালো থাকবেন দাদা। বিনম্র শ্রদ্ধা।’

সুবীর নন্দীর সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠানে বাজিয়েছেন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী মানিক আহমেদ। এই শিল্পীর সঙ্গে আর কোনো দিন বাজাতে পারবেন না, এটা ভাবতেই পারছেন না তিনি। লিখেছেন, ‘দাদা আর বলবে না, মানিক বাজা। ভাবতেই পারছি না, দাদা এভাবে চলে যাবেন। দাদা আপনি সুরের মহারাজ, যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। সারা জীবন আমাদের মনের মাঝে থাকবেন।’

কিংবদন্তি শিল্পীর মৃত্যুতে শোকার্ত চিত্রনায়িকা পূর্ণিমা। তিনি লিখেছেন, ‘কিংবদন্তি সুবীর নন্দী স্যার, আপনি শান্তিতে থাকুন।’

নাট্যকার মাসুম রেজা লিখেছেন, ‘সেলিম আল দীনের একটা বয়সভীতি ছিল। তাঁর পঞ্চাশতম জন্মদিন কাউকে জানতে দেননি। একান্নতে এসে জানা গেল তিনি পঞ্চাশ পেরিয়েছেন এক বছর আগেই। যা-ই হোক, তাঁর একান্নতম জন্মদিনেই পালিত হলো পঞ্চাশতম জন্মদিন। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের আয়োজনে ঘরোয়া পরিবেশে শিমুল আপা, আসাদ ভাই, পারুল ভাবি, শেলীসহ সেলিম ভাইও উপস্থিত। অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল সুবীরদার গান। তাঁর পাশে বসে একের পর এক শুনলাম তাঁর জনপ্রিয় গানগুলো—‘হাজার মনের কাছে’, ‘আমার এ দুটি চোখ’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি, আমাকে আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই’! মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম গানগুলো। সেলিম ভাই চলে গেছেন ১১ বছর আগে। আজ চলে গেলেন সুবীরদা। সুবীরদার গানের প্রতি মুগ্ধতা আমার কোনো দিনই কাটবে না। আপনাকে কাঁদাবার ভয় দেখিয়ে আর কোনো লাভ নেই। কিন্তু আমাদের মনটা তো কাঁদছে সুবীরদা।’

সুবীর নন্দীর গানে অভিনয়শিল্পী শতাব্দী ওয়াদুদ শোক প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি/ আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই’। প্রিয় সুবীর নন্দী, আপনি আপনার জীবদ্দশায় আপনার সুমিষ্ট কণ্ঠ এবং অসাধারণ গায়কি দিয়ে আমাদের হাসি-কান্নার অংশীদার হয়েছেন! আপনার গানের জন্য আপনি বাঙালির বুকে টিকে থাকবেন অনন্তকাল! ঈশ্বর আপনার আত্মার প্রতি সদয় হোন!’

অভিনয়শিল্পী শাহনাজ খুশি লিখেছেন, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সে কথা তুমি যদি জানতে, এই হৃদয় ছিঁড়ে যদি দেখানো যেত, আমি যে তোমার তুমি মানতে।’ বাংলাদেশে সুরের ঐশ্বর্য নিয়ে আপনি ঘুমিয়ে গেলেন! কীর্তিমানের মৃত্যু নাই। আপনি সারা জীবন বেঁচে থাকবেন আপনারই স্বর্গীয় সুরের ধারায়! বিনম্র শ্রদ্ধা।’

‘খাঁচা’ চলচ্চিত্রের পরিচালক নির্মাতা আকরাম খান লিখেছেন, ‘একাত্তরের পর নতুন বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে তুলতে যেসব শিল্পী অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে কণ্ঠের জাদুকর সুবীর নন্দী অগ্রগণ্য। সুবীর নন্দী, আপনার কাছে আমাদের ঋণ অপরিসীম। আপনার নিষ্ঠা ও মূল্যবোধের ঐতিহ্যকে ধারণ করে উৎকর্ষ অর্জনের লক্ষ্যে আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলন জারি রাখার শপথ করছি।’

সংগীতশিল্পী সন্দীপন বলেন, ‘মহান শিল্পী চলে যাননি, তাঁর গানে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ। সুবীর নন্দী, হে গানের রাজকুমার, তোমায় সশ্রদ্ধ প্রণাম।’

গীতিকার ও সংগীতশিল্পী শফিক তুহিন লিখেন, ‘সুবীরদা, বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।’