বেইলি রোড থেকে স্টকহোমে

সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা নাটকের দৃশ্য
সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা নাটকের দৃশ্য

ঢাকার মঞ্চে নতুন সংযোজন সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা নাটকটি। গত ২৬ এপ্রিল বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মঞ্চে থিয়েটার আর্ট ইউনিট নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন করে। ২ মে একই মঞ্চে নাটকটির দ্বিতীয় মঞ্চায়ন হয়। নাটকের তৃতীয় ও চতুর্থ প্রদর্শনী হয় সুইডেনের স্টকহোমের ফ্রিয়া ট্রিয়েটন মিলনায়তনে। সেখানে নাটকটির ভালো সাড়া পেয়ে দলের সদস্যরা বেশ উজ্জীবিত। তাঁদের অভিজ্ঞতা শুনে ও ঢাকায় নাটক দেখে লিখেছেন মাসুম আলী।

নতুন নাটক নিয়ে যেকোনো দলের মধ্যে উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা থাকে। আর দর্শকের ভালো সাড়া পেলে তো কথাই নেই, আনন্দের বন্যায় ভাসেন কর্মীরা। এমনটাই হয়ে আসছে। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের নতুন নাটক ‘সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা নিয়ে কর্মীদের আনন্দ একটু বেশিই বটে। রীতিমতো উৎসবমুখর অবস্থা দলের মধ্যে।

মোটেও বাড়িয়ে বলা হয়নি, দলের নবীন-প্রবীণ তিন কর্মীর কথা শুনলে (পড়লে) বিষয়টা পরিষ্কার হবে। দলের তরুণ কর্মী নীল চৌধুরী যেমনটা বললেন, ‘জীবনটা আসলেই ছোট না, অনেক বড়। আর আমি পরাজিত না সফল, সেটা এই সুইডেনের মাটিতে এসে উপলব্ধি করেছি। কখনো ভাবিনি, আমাদের এত কষ্টের ফসল আমরা এত পরিমাণে পাব। নাটক শেষে টানা ১০-১২ মিনিট সবাই দাঁড়িয়ে হাতে তালি, তা-ও আবার এমন এক দেশে, যেখানে দর্শক সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করেন। এটাই তো আমার জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।’

নাটকে সুইডিশ সূচিশিল্পী হ্যানা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সঙ্গীতা চৌধুরী। তাঁর মন্তব্য এমন, ‘সত্যিই এ এক বিরল অনুভূতি। বিদেশের মাটিতে এমন প্রশংসা পাওয়া পরম সৌভাগ্যের! আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই নাট্যভ্রমণ, আমার স্বপ্ন, আমার খুশি-আনন্দ ও আত্মবিশ্বাস যেন আরও অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।’ দলের জ্যেষ্ঠ সদস্য চন্দন চৌধুরীও আপ্লুত। তিনি বললেন, ‘আমরা ধারণার বাইরে সাড়া পেয়েছি। সেখানকার প্রথম শোতে বেশির ভাগই সুইডিশ দর্শক ছিলেন। পিনপতন নীরবতার মধ্যে তাঁরা নাটক দেখেছেন। নাটক শেষে এত করতালি পেয়েছি যে আমাদের অনেকের চোখে পানি এনে দেয় ঘটনাটি। পরের প্রদর্শনীতে ছিলেন কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি দর্শক। দেশি-বিদেশি সব দর্শক প্রশংসা করেছেন। অনেক দর্শকই বলেছেন, বাংলাদেশের মঞ্চনাটক এত দূর পৌঁছে গেছে, ধারণা ছিল না তাঁদের। সেখানকার বাংলাদেশের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মঞ্চে উঠে বলেছেন, এই নাটকের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পথ প্রশস্ত হলো।

সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের অংশ হিসেবে সুইডেনের সন্দ্রেবালস অপেরার আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে ১৯ জনের দল নিয়ে স্টকহোমে যায় থিয়েটার আর্ট ইউনিট। ১০ ও ১১ মে স্টকহোমের ফ্রিয়া ট্রিয়েটন মিলনায়তনে নাটকটির দুটি মঞ্চায়ন হয়। এটি থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ৩৪তম প্রযোজনা।

সুইডেনে এই নাটকের ভালো সাড়া পড়ার বেশ কিছু কারণের মধ্যে অন্যতম একটি হলো নাটকটির গল্প। সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা নাটকটি মূলত পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই নারীর উপাখ্যান, যেখানে হ্যানা বিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে জন্ম নেওয়া সুইডেনের এক সূচিশিল্পী। আর শাপলা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের এক কর্মী। নাটকটি মূলত এই দুই নারীর পরস্পরের গল্পকথন; দুজন মৃত নারীর গল্পকথন। সূত্রধরের হাত ধরে পালারীতিতে এগিয়ে যায় নাটক।

আনিকা মাহিনের লেখা নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন রোকেয়া রফিক বেবী। ঢাকার দুটি প্রদর্শনীতে ছিল মিলনায়তনভর্তি দর্শক। প্রদর্শনী দেখে সহজেই গল্পটা মনে গেঁথে যায়। নাটক শুরু হয় পালা দিয়ে। গায়েন বর্ণনা শুরু করে হ্যানার জীবনগাথা। পাহাড়, হ্রদ আর তুলার মেঘের বর্ণনায় উচ্ছল কিশোরী হ্যানা। কিন্তু হঠাৎ পালার ছন্দপতন ঘটাতে আবির্ভাব হয় শাপলার। শাপলা বলতে শুরু করে তার নিজের গল্প। এবার পালা এগিয়ে চলে দুজনের গল্প নিয়ে। তবে সনাতন পালা নয়, নির্দেশক তাঁর নিজের মতো করে উপস্থাপন করেন নাটক।

সুতায় সুতায় হ্যানা ও শাপলা সংগীতপ্রধান নাটক। গীতল পরিবেশ নাটকজুড়ে, যেখানে হ্যানার গল্পটা তার দেশের গল্প, সুইডেনের গল্প। মায়ের গল্প, সূচিকর্মের গল্প, প্রেমের গল্প, শিল্পের জন্য ত্যাগের গল্প। গল্পের একপর্যায়ে হ্যানার প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ের কথা পাকাপাকি, বিয়ে নিয়ে সব তোড়জোড়। কিন্তু যখন শুনতে পায় প্রেমিকের মুখে, বিয়ের পর ছেড়ে দিতে হবে তার শিল্পকর্ম, তখন এক কঠিন সিদ্ধান্তের সম্মুখীন হয় হ্যানা। সে সিদ্ধান্ত নেয়, গতানুগতিক জীবন তার জন্য নয়, তার বেঁচে থাকা মায়ের দিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য নিয়ে, সূচিকর্ম নিয়ে। শিল্পের প্রতি তার প্রগাঢ় প্রেম তাকে স্থির করে শিল্পের নির্যাস নিয়ে বেঁচে থাকতে।

শাপলার গল্পটা ঢাকার দর্শকের পরিচিত গল্প। সব হারানোর গল্প। শাপলার বাবার মৃত্যুর পর অভাবের তাড়নায় চলে আসে গ্রাম ছেড়ে শহরে। আর পেছনে ফেলে আসে তার গ্রাম, তার মা, আর নকশিকাঁথা। ফেলে আসা সুই-সুতার বদলে তার হাতে উঠে আসে কলের যন্ত্র। শাপলা শিল্পী থেকে হয়ে ওঠে শ্রমিক। একপর্যায়ে শাপলার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা, অন্ধকার—হঠাৎ মায়ের মৃত্যুসংবাদ আসে একদিন। এর কিছুদিন পর শাপলা তার শরীরের ভেতর নতুন প্রাণের আভাস টের পায়। বিবাহহীন সম্পর্কের ভেতরে মাতৃত্ব? এই কঠিন প্রশ্ন তাকে ঠেলে নিয়ে যায় আত্মহত্যার পথে। পর মুহূর্তে শাপলা সিদ্ধান্ত নেয় বেঁচে থাকার। তার নিজের জন্য, অনাগত জীবনের জন্য। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। কারখানার অগ্নিকাণ্ডে শাপলার জীবন শেষ হয়, শেষ হলো শাপলার গল্প। আর দর্শকের মন খারাপ হয়, শত শত শাপলার হারিয়ে যাওয়া তাঁরা দেখেছেন এই বাংলায়।

নাটক শেষে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, ভাষা, স্থান ও কালের যতই দূরত্ব থাকুক না কেন, পৃথিবীর সব প্রান্তের নারীর সংগ্রাম এক। নির্দেশক রোকেয়া রফিক বেবী বলেন, ‘কাহিনিতে দুজন মৃত নারীর সময়ের ফারাক প্রায় শতবর্ষ, আর দূরত্ব হাজার মাইল। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে গল্পের সরলরৈখিক উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি।’ নাট্যকর আনিকা মাহিন বলেন, ‘হ্যানা ও শাপলা নাটকটি লিখতে গিয়ে আমি শাপলার গল্পটি খুঁজতে শুরু করলাম, খুঁজতে শুরু করলাম তার শৈল্পিক সত্তাকে। এ করতে গিয়ে নাটকটি আশ্রয় নিল পালা ফর্মে। নাটকের গল্প হ্যানার সত্য ঘটনা অবলম্বনে; যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শাপলার কাল্পনিক চরিত্র। নাটকে শাপলার শৈল্পিক সত্তা ফুটে ওঠে নকশিকাঁথার মাধ্যমে।

নাটকটিতে অভিনয় করছেন সুজন রেজাউল, সংগীতা চৌধুরী, মিতালী দাস, মেহমুদ সিদ্দিকী, নূরুজ্জামান বাবু, এস আর সম্পদ, সজল চৌধুরী, আবীর সায়েম, অপ্সরা মৌ। নাটকটির মূল গায়েন সেলিম মাহবুব আর গায়েন দলে ছিলেন চন্দন রেজা, কামরুজ্জামান মিল্লাত, আনিকা মাহিন, মাহফুজ সুমন।