দেশপ্রেমের সংজ্ঞা

জাপানের বনসাই শিল্পী কুনিও কোবাইশির সঙ্গে তাহসান
জাপানের বনসাই শিল্পী কুনিও কোবাইশির সঙ্গে তাহসান

বছর কয়েক আগে অস্ট্রেলিয়ার বন্ডি বিচে সার্ফিং শেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রথম আলোতে লিখেছিলাম। আজ আবার অনেক দিন পর লিখতে বসলাম। এবার যে দেশের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখছি, সেখানে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ জয় করার মতো রোমাঞ্চ হয়তো ছিল না, কিন্তু এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছিল।

এই যাত্রায় আমার সুযোগ হয়েছিল কিছু সুন্দর জায়গা দেখার, অনেক গুণী মানুষের সঙ্গে গল্প করার। আমি আজ সেই জায়গাগুলোর নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে লিখব না। আজ লিখব আমি সেই জায়গার মানুষদের নিয়ে, যাদের কাছে একটা অতিপরিচিত শব্দের সংজ্ঞা আমি শিখেছি। তাদের কাছ থেকে শেখা সেই কথাগুলো আমার দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করছি। হয়তো সমমনা দেশপ্রেমিক কিছু মানুষ কথাগুলো থেকে এমন কিছু খুঁজে নেবেন, যা সমষ্টিগতভাবে আমাদের নতুন করে ভাবাবে।

প্রথমেই আমি যে মানুষের কথা বলব, তিনি একজন বিখ্যাত সুশি রন্ধনশিল্পী (শেফ)। তাঁর আমন্ত্রণে সেই শেফের রেস্টুরেন্টে যাওয়ার সুযোগ পাই। প্রতিদিন সকালে তিনি নিজে একদম টাটকা মাছ বাছাই করে কিনতে বাজারে যান। পছন্দসই মাছের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করেন সেদিনের মেনু। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, যেদিন সবচেয়ে ভালো মাছটা তিনি বাজারে পেতে ব্যর্থ হন, সেদিন তিনি নিজে ফোন করে ক্ষমা চেয়ে নেন অগ্রিম খাবারের অর্ডার দেওয়া ক্রেতাদের কাছ থেকে এবং অর্ডার বাতিল করে দেন। এ রকম ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে থাকে সেই শেফের রেস্টুরেন্টে।

স্বভাবতই আমার প্রশ্ন ছিল, এতে তাঁর লোকসান হয় না? তাঁর উত্তর ছিল, যাঁরা তাঁর রেস্টুরেন্টে আসেন, তাঁরা আত্মীয়ের মতোই আপন। তাঁদের বাজে খাবার পরিবেশন করে কোনোভাবেই তিনি শান্তি পাবেন না। তাই আপন মানুষদের ঠকিয়ে বাড়তি লাভের চিন্তা কখনোই তাঁকে টানে না। তাঁর চিন্তা একটাই, তিনি যেন সবচেয়ে ভালো মানের খাবার তাঁর ক্রেতাদের পরিবেশন করতে পারেন। সেই সুশি শেফের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমাদের দেশের ভেজাল খাবারের ছড়াছড়ি নিয়ে প্রকাশিত খবরগুলোর কথা তখন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

>জাপানের প্রত্যেক মানুষ একে অপরকে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মতো শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসে। আর পরিবারের সবার জন্য সবচেয়ে ভালোটাই সবাই দিতে চান। তাই সব ক্ষেত্রেই সব মানুষ তাঁদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেন সর্বোৎকৃষ্ট মানের কাজই করতে। এটাই তাঁদের লক্ষ্য।

দ্বিতীয় মানুষটা আগের জনের মতো বিখ্যাত কেউ নন। তিনি একটা ঘড়ির কারখানার কর্মচারী। তাঁর সঙ্গে আলাপের সময় একই রকম অনুভূতি হয়েছিল আমার। বারবার গুণগত মান রক্ষার পেছনে তাঁর আর কারখানার শ্রমিকদের অক্লান্ত প্রয়াসের কথা বলছিলেন তিনি। আমি খানিকটা অধৈর্য হয়েই জানতে চাইলাম, কেন জাপানের সবার মধ্যে এই একই ধ্যানজ্ঞান? গুণগত মান রক্ষার দৌড়ে সবাই কেন এগিয়ে থাকতে চান? এর উত্তর আমাকে এখনো ভাবায়। ওই ঘড়ির কারখানার কর্মচারীর ভাষ্যমতে, জাপানের প্রত্যেক মানুষ একে অপরকে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মতো শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসে। আর পরিবারের সবার জন্য সবচেয়ে ভালোটাই সবাই দিতে চান। তাই সব ক্ষেত্রেই সব মানুষ তাঁদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেন সর্বোৎকৃষ্ট মানের কাজই করতে। এটাই তাঁদের লক্ষ্য। এই কথা শুনে কেন যেন মনে হচ্ছিল এই কথাগুলো আমার দেশের প্রত্যেকটা মানুষের শোনা প্রয়োজন।

কাঁচাবাজারের ওই মানুষ, যিনি মাছে ফরমালিন দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন না; কিংবা হাজার কোটি টাকার অধিপতি, যাঁর তৈরি অস্বাস্থ্যকর ভোজ্য তেলের মান প্রশ্নবিদ্ধ, তাঁদের সবারই প্রয়োজন জাপানের কাছ থেকে দেশপ্রেমের সংজ্ঞাটা জেনে নেওয়া। আমি যেমন জানলাম আমার এবারের জাপান–যাত্রায়।

লেখক: সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা