শোনা যায় না গান, বন্ধ হয়েছে দোকান

সারা দেশের অডিও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হতো পাটুয়াটুলী ও নবাবপুর থেকে
সারা দেশের অডিও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হতো পাটুয়াটুলী ও নবাবপুর থেকে

শনিবার দুপুর। পাটুয়াটুলী ও নবাবপুর এলাকায় কাটল তিন ঘণ্টা। দুটি এলাকাই সরগরম। মানুষের হাঁকডাক, যানবাহনের আওয়াজ। অগণিত শ্রমিক ব্যস্ত মাল ওঠানো–নামানোতে। শুধু একটাই শূন্যতা, সেখানে এখন আর গান বাজে না। নেই গানের বাজার। অথচ কয়েক বছর আগেও সারা বছরই এখানে শোনা যেত গানের আওয়াজ। এখানে পথে চলতে গেলে ভেসে আসত নতুন কাগজের গন্ধ। এলাকার ভবনগুলোর দেয়ালে থাকত নতুন অ্যালবামের পোস্টার। ঈদ এলে এখানে রীতিমতো উৎসব লেগে যেত। শত শত এমনকি হাজারো নতুন অ্যালবামের মুক্তির স্রোত বয়ে যেত এই বাজারে। দেশের অডিও বাজার নিয়ন্ত্রণ হতো এই এলাকা থেকে।

তাহলে ঈদ সামনে রেখে কোথায় গেল আগের সেই সরগরম অডিও বাজার? দেয়ালে দেয়ালে নেই নতুন অ্যালবামের পোস্টারের ছড়াছড়ি, নেই শত শত ক্যাসেট কিংবা সিডি। অথচ কয়েক বছর আগেও এই সময় নগরীর বিনোদন সাংবাদিকদের অন্যতম ‘বিট’ হয়ে যেত পাটুয়াটুলী ও নবাবপুর। তার কিছুই নেই এখন।

গতকাল শনিবার ঘণ্টা তিনেক এই দুটি এলাকায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও দেশের প্রথম সারির সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো বিক্রয়কেন্দ্রের দেখা মিলল না। নেই অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানেরও কোনো কার্যালয়। কয়েক বছর আগে যেখানে ছিল শুধু ক্যাসেট সিডির দোকান, এখন সেখানে মোবাইল, মেমরি কার্ড, ঘড়ি, বোরকা, এমনকি বিরিয়ানির দোকান।

সংগীতার মূল বিক্রয় কেন্দ্র ও অফিস ছিল যেখানে, সেখানে এখন ছোট ছোট দোকান
সংগীতার মূল বিক্রয় কেন্দ্র ও অফিস ছিল যেখানে, সেখানে এখন ছোট ছোট দোকান

নবাবপুরের পাহলোয়ান ইলেকট্রিক মার্কেটে ছিল দেশে শীর্ষস্থানীয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেকের দোকান। শনিবার সেখানে গিয়ে ক্যাসেট সিডির কিছুই মেলেনি। এখন সেখানে একটি ইলেকট্রনিক পণ্যের গোডাউন। নিচের এক পান–সিগারেটের দোকানি জানালেন, কয়েক বছর আগে সাউন্ডটেক এখানে ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেছে। তারপর সেখানে কিছুদিন মিষ্টির দোকান ছিল। পরে সেটিও উঠে গেছে।

পাটুয়াটুলী রাবেয়া ইলিয়াস মার্কেটে একসময় প্রায় সবগুলো দোকান ছিল অডিও ক্যাসেট ও সিডির পাইকারি ব্যবসার প্রতিষ্ঠান। সেখানে এখন ঘড়ির দোকান। ৩৭ নম্বর পাটুয়াটুলীর নুরুল হক মার্কেটের দোতলায় ছিল দেশের আরেক শীর্ষস্থানীয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সংগীতার মূল বিক্রয় কেন্দ্র ও অফিস। এখানেই প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা বসতেন। একটি ফ্লোরের পুরোটাজুড়ে ছিল সংগীতার কর্মকাণ্ড। গোডাউন ও বিক্রয় কেন্দ্রের কিছু অংশ ছিল অন্য ফ্লোরেও। সেখানে এখন ছোট ছোট দোকান করা হয়েছে।

পাটুয়াটুলীর ক্রাউন কমপ্লেক্স আর এর আশপাশের ভবনে ছিল বিউটি কর্নার, অনুপম, চেনা সুর, সোনালি প্রডাক্টস প্রভৃতি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের মূল কেন্দ্র। এখন রাবেয়া ইলিয়াস, সরকার মার্কেট, হাজী ইলিয়াস মার্কেটে গানসংশ্লিষ্ট একটি দোকানও নেই। নিউ সামাদ ইলেকট্রনিকস নামের ক্যাসেট ও সিডি বিক্রির পাইকারি প্রতিষ্ঠানটি একই নাম দিয়ে টেলিভিশন বিক্রির দোকান সাজিয়েছে।

বিজয়নগরের সিএমভি মিউজিকের একটি বড় বিক্রয় কেন্দ্র এবং ব্যবসা পরিচালনা কার্যালয় ছিল। সেখানে এখন একটি সেলুন আর খাবারের দোকান। স্টেডিয়াম এলাকার সুইমিংপুল মার্কেটের সারগাম তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে অনেক আগে। সেখানে দেখা গেল ইলেকট্রিক পণ্যের দোকান। মগবাজারের ওয়ার্ল্ড মিউজিকও পুরোপুরি বন্ধ। কার্যক্রম নেই দোয়েল প্রোডাক্টসেরও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম পাইকারি অডিও বাজার চট্টগ্রামের চিত্র একই। শহরের রেয়াজউদ্দিন বাজারের শীর্ষস্থানীয় অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আমিন স্টোর, বিনিময় স্টোর, জাহেদ ইলেকট্রনিকস, ন্যাশনাল ইলেকট্রনিক, শাহ আমানত অডিও কমপ্লেক্স এখন আর গানের অ্যালবামই বের করে না। অনেক নামী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান অন্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

পাটুয়াটুলী রাবেয়া ইলিয়াস মার্কেটে একসময় প্রায় সবগুলো দোকান ছিল অডিও ক্যাসেট ও সিডির পাইকারি ব্যবসার প্রতিষ্ঠান। এখন সেখানে ঘড়ির দোকান
পাটুয়াটুলী রাবেয়া ইলিয়াস মার্কেটে একসময় প্রায় সবগুলো দোকান ছিল অডিও ক্যাসেট ও সিডির পাইকারি ব্যবসার প্রতিষ্ঠান। এখন সেখানে ঘড়ির দোকান

পাটুয়াটুলীতে অডিও ব্যবসায়ী প্রযোজক সমিতির কার্যালয় এখন আর নেই। সংগঠনটির সক্রিয় সদস্য প্রযোজক ও গীতিকার হাসান মতিউর রহমান বলেন, ‘সেখানে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ নামে রূপান্তরিত হয়ে কিছুদিন সংগঠনের কার্যক্রম চালু রাখি। পরে সেটিও নিজেরদের দ্বন্দ্বে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।’

জানা গেছে, ছোট ও মাঝারি সবগুলো প্রতিষ্ঠানই এখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ২২ হাজার কর্মী পেশা ছেড়েছেন।

প্রথম ধাক্কা এমপি থ্রি। সারা দেশের অডিও বাজারের প্রথম ধস নামে যখন এমপি থ্রির দৌরাত্ম্য শুরু হয়। যদিও কয়েকজন প্রযোজকের দাবি, মূলত পাইরেসির কারণেই ব্যবসার ধসে পড়েছে অডিও শিল্প। তবে এ কারণকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন না অনেক প্রযোজক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক প্রযোজক বলেন, মূলত কয়েকটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করে বিদেশি অ্যালবাম পাইরেসি করে স্থানীয়ভাবে প্রকাশ করত। এ ক্ষেত্রে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হতো। অডিও বাজার প্রথম ধাক্কা খায় এমপি থ্রির দৌরাত্ম্যে। শুরুতে একটি সিডিতে এমপি থ্রি ফরম্যাটে অনেকগুলো গানের অ্যালবাম করে ফুটপাতে বিক্রি করা হতো। কিছুদিন পর এমপি থ্রি ফরম্যাটে একসঙ্গে অনেকগুলো অ্যালবামের গান বিক্রি শুরু হয়। একসঙ্গে এক সিডি বা এমপি থ্রি যন্ত্রে অনেকগুলো অ্যালবামের গান পেয়ে শ্রোতারা নতুন গানের বৈধ অ্যালবামের প্রতি বিমুখ হন। কমে যায় অ্যালবাম বিক্রির পরিমাণ।

দ্বিতীয় ধাক্কা অন্তর্জাল ও মোবাইল। একসময় বিষয়টি সিডিতে সীমিত থাকেনি। পুরোপুরি নির্ভর হয়ে পড়ে অন্তর্জাল এবং মোবাইলে। হয়ে পড়ে ইউটিউবনির্ভর। শেষ হয় বহু গানের অ্যালবামের যুগ। শুরু হয় এক গানের এক অ্যালবামের যুগ।

এ পরিস্থিতিতে মাঝে কিছুদিন বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোও কিছু বুঝতে না পেরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। পরে ছোট পরিসরে কেউ কেউ আবার ব্যবসা শুরু করেন। পাটুয়াটুলী নবাবপুরের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান মগবাজারে একটি গলিতে চলে আসে। মূলত গানের বাজারের পাটুয়াটুলী নবাবপুরের রাজত্ব এখন মগবাজারে। অবশ্য কেউ কেউ আলাদাভাবে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে।

প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সংগীতা পাটুয়াটুলী কিংবা নবাবপুরের সবকিছু চুকিয়ে বিজয়নগরের একটি ভবনের ফ্ল্যাটে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা সেলিম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসা আগের মতো নেই। এখন ব্যবসার ধরন বদলে গেছে। শুধু ঐতিহ্য বজায় রাখতে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি।’

সাউন্ডটেক নবাবপুর থেকে ব্যবসা গুটিয়ে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিল। পরে প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা সুলতান মাহমুদ বাবুল তাঁর নিজের বাসার নিচে একটি ফ্ল্যাটে ব্যবসায়িক কার্যালয় বানিয়ে নতুন উদ্যমে ব্যবসা শুরু করেছেন। চেনা সুরের উদ্যোক্তা হাসান মতিউর রহমানও তাঁর মগবাজার নয়াটোলা এলাকায় নিজের বাসার নিচে একটি কক্ষে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

বিজয়নগরের সিএমভি মালিকানা বদলের পাশাপাশি জায়গাও বদল করেছে। মগবাজার থেকে চলছে এর কার্যক্রম। সিএমভির বর্তমান স্বত্বাধিকারী শেখ সাহেদ আলী বলেন, ‘এটা ঠিক, এখন সবাই গান ইউটিউবে শুনছেন ও দেখছেন। আমরাও সেদিকে জোর দিচ্ছি।’

প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লেজার ভিশনের অন্যতম উদ্যোক্তা আরিফুর রহমান বলেন, ‘প্রযুক্তি অগ্রাহ্য করা যাবে না। এটা সব সময় আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা চেষ্টা করছি প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে চলতে।’