আমি একেবারে একলা মানুষ

কবরী। ছবি: কবির হোসেন।
কবরী। ছবি: কবির হোসেন।
>

ষাটের দশকে প্রথম ছবি সুতরাং দিয়েই দর্শকদের হৃদয় হরণ করেছিলেন কবরী। এরপর ছবির পর ছবিতে দিগ্‌বিজয়ের পালা। তাঁর চলচ্চিত্রের অর্ধশতক আশ্চর্য সফলতার গল্প—অভিনয়ে, প্রযোজনায়, পরিচালনায়। চলচ্চিত্রাঙ্গন থেকে রাজনীতির আঙিনায় এসে হয়েছিলেন সাংসদ। গত ৬ মে বিকেলে আলাপনে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছে তিনি মেলে ধরেছেন অন্তরের ঝাঁপি।

মতিউর রহমান: আপনি ছিলেন মিনা পাল, হলেন কবরী। মিষ্টি মেয়ে বলেও আপনাকে অনেকে ডেকে থাকেন। আপনার সিনেমাজগতে কাটানো প্রায় ৫৫ বছরের জীবনটা কেমন ছিল?
কবরী: জীবন তো এ রকমই। প্রত্যেকের জীবনেই আলাদা বিষয়বস্তু, দুঃখ-কষ্ট আর অনেক ঘটনা থাকে। আমার জীবনও সেভাবেই গড়ে উঠেছে। ছোটবেলায় একেবারে না বুঝে পরিবারে ভাইবোনদের সঙ্গে গল্প করতাম। সে সময় এক ধরনের জীবন ছিল। আসলে মা-বাবা, ভাইবোন—এরা মিলেই তো পরিবার। কত আনন্দে সময় কেটেছে!

একটা সময়, কিছু শব্দ, কিছু পৃষ্ঠা—এর ভেতরেই তো আমার জীবনকাহিনি। জীবনের পুরোটা সময় তো আর কাজ করতে পারিনি। কাজ করেছি নির্দিষ্ট একটা সময়ে। এখন যদি আমার বয়স ৬০ বছরের বেশিও ধরি, এই সময়ে  অনেক কাজ আমি করেছি। শুধু চলচ্চিত্র নয়, নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজেও অংশ নিয়েছি।

প্রথম থেকে যদি ধরি, আমি বেড়ে উঠেছি, স্কুলে পড়েছি, সিনেমায় কাজ করেছি, পাশাপাশি সামাজিক কাজও করেছি। মা হয়েছি। পাঁচ সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়েছি। তাদের মানুষ করেছি। বলতে পারেন, আমি একেবারে একলা মানুষ। একলা আমার জীবন। চলতে চলতে অনেকের সঙ্গে জড়িয়েছি। ভালো মানুষের সঙ্গে যেমন মিশেছি; আবার চলার পথে অনেক মন্দ মানুষেরও পরিচয় পেয়েছি। ওরা আমাকে আঁকড়ে ধরে নিজেদের লাভ খুঁজেছে। জীবন অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন আমার পুরোনো স্মৃতিগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। যোগ হচ্ছে নতুন স্মৃতি। প্রতিমুহূর্তেই আমি আমার সামনে একটা নতুন পৃথিবী দেখতে পাচ্ছি।

মানুষের জীবনে অনেকগুলো দরজা থাকে। তার মধ্যে মৃত্যু হলো শেষ দরজা। মৃত্যুর কথা মনে হলে আমার চোখ জলেতে ভরে যায়। কবরী আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, সামান্য একটু কথা বলতেও নয়। সবাইকে ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যেতে হবে, ভাবলেই ভয় লাগে। তাই মৃত্যুর আগপর্যন্ত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। যত দিন বাঁচব, মানুষের কাছে আপন হয়ে থাকতে চাই, মানুষের কাছাকাছি থাকতে চাই। আরও কিছু উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।

সুতরাং ছবিতে সুভাষ দত্তের সঙ্গে কবরী।
সুতরাং ছবিতে সুভাষ দত্তের সঙ্গে কবরী।



মতিউর:
জীবন নিয়ে এই যে এত সুন্দর কতগুলো কথা বললেন। এ দীর্ঘ জীবনটা কি আপনি উপভোগ করেছেন? আনন্দ পেয়েছেন?
কবরী: আনন্দ পেয়েছি। আনন্দ না পেলে তো জীবনটাকে উপভোগ করতে পারতাম না। জীবনে আনন্দ ছিল বলে কষ্টটাকেও বুঝতে পেরেছি। যখন কোনো কাজ করতে গিয়ে বাধা পেয়েছি, তখন খুব আঘাত পেয়েছি।

আমার একটা দুঃখ রয়ে গেল, জীবনে আমি একজন ভালো বন্ধু পেলাম না, ভালো স্বামী পেলাম না। সন্তানেরা অনেকটা যার যার মতো করে আছে। কিন্তু সঙ্গ দেওয়ার মতো একজন ভালো মানুষ আমি পাইনি, যাকে বলতে পারি, এসো, এক কাপ চা খাই, একটু গল্প করি। এটাই হয়তো মানুষের জীবন। তবে মানুষের চাওয়ার তো শেষ নেই। মনে হয়, যদি আমার একজন বন্ধু থাকত, তাহলে যখন-তখন তার সঙ্গ পেতাম। এই আনন্দটুকু আমি পাইনি। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস। আমি দিতে পারি। সারা জীবন অনেক দিয়েছি। কিন্তু নিতে আমার খুবই কষ্ট। কারণ মনে হয় যে নিজে নিতে গেলে আমি ছোট হয়ে যাব। নিতে গেলে মনে হবে, আমি একজন দুর্বল মানুষ হয়ে উঠছি। যে ভালোবাসে, সব সময় সে মনে করে, ভালোবাসাটাই বড় কাজ। সব সময় মানুষকে তো দিয়েই গেলাম। কারও কাছ থেকে কিছু পাইনি। কারও কাছ থেকে কিছু চাইওনি। এই যে সবাইকে দিয়ে গেলাম, ভালোবেসে গেলাম, তার বিনিময় প্রত্যাশা করাটা অনুচিত।

মতিউর: আপনার আত্মস্মৃতি পড়ে, আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, আপনার মধ্যে একজন ভালো বন্ধু, মমতা বা ভালোবাসা পাওয়ার আকুতি রয়ে গেছে। আপনি সেটা কেন পেলেন না? পরিবেশ বা ব্যক্তিজীবনে পরিস্থিতি অনুকূল ছিল না?
কবরী: এমন করেও হয়তো বলতে পারি, তাহলে কি আমারই ভুল? আমিই কি মানুষ চিনতে পারিনি? কিংবা যে মানুষটি আমাকে চেয়েছে, আমিও হয়তো তাকে বুঝতে পারিনি। আমার একটা খুঁতখুঁতে স্বভাব আছে। অনেক সময় অনেক বড় বিষয়কে আমি গুরুত্ব দিই না, কিন্তু কোনো ছোট বিষয়ও মনে ধরে গেলে মনে হয়, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? তখন প্রাপ্তিটুকুই আমি আঁকড়ে ধরতে চাই।

প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে এমন হয়েছে যে আমার ভাবনা আর আমার চাওয়া যেমন, অন্যরা আসলে সে রকম নয়। তাঁরা আমাকে বুঝতে পারেনি। ওই যে বললাম, আমি তো শুধু দিতেই চাই, নিতে চাই না। নেওয়ার মধ্যে শুধু এটুকুই যে কাউকে ভালো লেগে গেলে তার একটু পাশে থাকা হলো। কিন্তু সে, আমার ভালো লাগার সেই মানুষটি তখন হয়তো ভাবছে, ‘এই সুযোগে আমার যা পাওয়ার, সেটা নিয়ে চলে যাই।’ আমার সঙ্গে বেশির ভাগ এ ধরনের মানুষেরই পরিচয় হয়েছে। কিন্তু আমি তো তাকে বিয়ে করতে চাইনি, তার কাছ থেকে অন্য কোনো কিছুও চাইনি। শুধু এটুকু চেয়েছি যে, আমি যে তাকে ভালোবাসি, তার সম্মানটুকু যেন পাই।

মতিউর: প্রথম জীবনে দ্রুতই তো বিয়ে হয়ে গেল আপনার।
কবরী: না। আমার বিয়ে হয়নি, বিয়ে করতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম। বিয়েটা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিবারের কথামতো করতে হয়েছিল। সুতরাং সিনেমার শুটিং শেষ করেছি মাত্র। তখনো অতটা জনপ্রিয়তা পাইনি। জনপ্রিয়তা তো এসেছে সিনেমাটা মুক্তি পাওয়ার পর। সে সময় নিজের পছন্দমতো কিছু করার অবস্থা ছিল না। তার ওপর ছিল পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা। সব মিলিয়ে প্রথম বিয়েটা করতে বাধ্য হই।

পাঁচ ছেলের সঙ্গে কবরী।
পাঁচ ছেলের সঙ্গে কবরী।

মতিউর: আত্মস্মৃতিতে আপনি কয়েকজন বিদেশি মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন, যাঁদের আপনি পছন্দ করেছিলেন, হয়তো সাময়িকভাবেই। কিন্তু সে সময় এত অভিনয় করলেন, এত জায়গায় গেলেন, বাংলাদেশের সেরা মানুষগুলোর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল। দেশের অনেক বিখ্যাত পরিচালক, প্রযোজক, সুদর্শন নায়কেরাও সে সময় ছিলেন। ছিলেন জনপ্রিয় নায়ক রাজ্জাক। তাঁকে নিয়ে তো কিছু প্রচারণা ছিল। কিছু প্রচারণা ছিল জহির রায়হানকে নিয়েও। তাঁদের কাউকে পছন্দ হয়নি, কেউ আপনার বন্ধু হয়নি?
কবরী: আমি কাউকে পাইনি। জহির রায়হানের সঙ্গেও আমার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। বয়স তখন কম ছিল। অনেক কিছু বুঝতেও পারতাম না। তা ছাড়া জহির রায়হান কোনো কিছু প্রকাশও করেননি। আসলে ওই সময় জহির রায়হান সিনে ওয়ার্ল্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন আমার অগ্রজ, সুঅভিনেত্রী সুলতানা জামানও। জহির রায়হান আমাকেও তাঁর প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এই নিয়ে কিছু মানুষ বাইরে মুখরোচক নানান কথা ছড়িয়েছিল, যা ছিল একদমই অপপ্রচার। বিষয়টি নিয়ে জহির রায়হানও কিছু বলেননি বলেই হয়তো অনেকের মধ্যে এ নিয়ে খানিকটা কৌতূহল রয়ে গেছে। আর রাজ্জাক সম্পর্কে বলব, তিনি ছিলেন বিবাহিত। তাঁর সঙ্গে তো কোনো সম্পর্কের প্রশ্নই আসে না। তিনি আমার সহশিল্পী এবং খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। তাঁর পরিবারের সঙ্গে এখনো আমার হৃ্দ্যতা রয়েছে।

আবার এমন অনেকে ছিলেন, যাঁরা বিবাহিত না হলেও আমার মানসিকতার সঙ্গে তাঁদের মিল ছিল না। আমার পছন্দ হয়নি। ওরা বলেছে, আমি বলিনি, নাকি আমি বলেছি, ওরা বলেনি—তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু কথা হলো যে সেভাবে হয়নি আসলে। মন–মানসিকতায় মিল হওয়ার মতো আমার জীবনে আসেনি।

মতিউর: এত নায়ক, এত অনুরাগী, লেখক—কেউ কি আপনার জীবনে আসেনি তাহলে?
কবরী: না, আসেনি। অনেকে বলেছে, আপনার ছবি দেখে বড় হয়েছি ইত্যাদি। এমন অনেক কিছুই শুনেছি। দেখুন, আমার টাকা না থাকতে পারে, কিন্তু আমার মন তো কোটি টাকার চেয়েও বেশি। এ জন্য কারও সঙ্গে আমার বনেনি। এটা হলো আমার আসল রহস্য। আমার মনটা যে রকম, সে রকম কাউকে আমি পাইনি।

মতিউর: কেউ যদি এমন বলে যে নিজেকে আপনি উচ্চ মূল্যায়ন করছেন, তার উত্তরে কী বলবেন?
কবরী:  হ্যাঁ, আমার ভেতরে কিছুটা অহংবোধ আছে। লোভ আমাকে কখনো মাটিতে ফেলতে পারেনি। যাঁদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত অনেকের সঙ্গেও আমার সখ্য হয়েছে—যাঁরা আন্তরিক ছিলেন, ভালো ছিলেন। আমি কখনো মানুষের চেহারা দেখিনি। দেখেছি তাঁদের সততা, বুদ্ধি, গুণ—এই সব।

মতিউর: কোনো দিন কেউ আপনাকে ভালোবাসার কথা বলেনি?
কবরী: হ্যাঁ, হয়তো বলেছে। তবে বেশির ভাগ সময়েই শুনেছি, আমাকে নাকি তারা ভয় পায়।

মতিউর: আপনাকে কেউ চিঠি লেখেনি?
কবরী: হ্যাঁ, লিখেছে। চিঠি লিখেছে। বলেছে, পছন্দ করি। কিন্তু ভালোবাসা বা বিয়ে-টিয়ের কথা কেউ বলেনি।

মতিউর: নামকরা কেউ লিখেছে?
কবরী: না। তারা অন্যকে দিয়ে খবর দিয়েছে। এর মধ্যে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিও ছিলেন। এখনো বোধ হয় কেউ কেউ আছেন। এরা হয়তো আসবেন। জড়িয়ে ধরবেন। চুমু খাবেন। ব্যস, অদ্দূরই। এ রকম মানুষ তো আমার দরকার নেই। আমি তো এটা চাই না, আমি ভালোবেসে বেঁচে থাকতে চাই। এ জন্য আমার জীবনে কেউ আসেনি।

দেবদাস সিনেমা করার সময় পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার সঙ্গে তো আমার অনেক দিনের পরিচয়। আচ্ছা, আপনি তো কোনো দিন বললেন না যে কবরী, আপনাকে ভালোবাসি। চাষী বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনাকে এত ভয় পাই যে যদি ভালোবাসার কথা বলি, তাহলে হয়তো আপনি আমাকে মারবেন।’ অথচ চাষীর সঙ্গে দিনের পর দিন কত গল্প করেছি, কত সুন্দর সময় কাটিয়েছি আমরা। এত ভালো বন্ধুত্ব ছিল যে বলে সেটা প্রকাশ করা যাবে না।

মতিউর: আপনি এমন কাউকে খুঁজেছেন, যিনি সাধারণ, কিন্তু সুন্দর, আপনার ভালো লাগাকে সম্মান করবেন। এভাবেই হয়তো জীবনের সঙ্গে জীবন মিলে যায়। তারপরও পার্থক্য থাকতে পারে। আবার এ প্রশ্ন যদি আসে, এত সূক্ষ্ম জীবনবোধ বা চিন্তা নিয়ে কি জীবন চলে?
কবরী: চলবে না কেন? এগুলো কোনো কঠিন বিষয় তো নয়। আমার সঙ্গে জীবন চালানো কঠিন নয়। খুবই সোজা। এ কথা বলছি, কারণ আমি ছাড় দিতে পারি। আমি প্রচুর ছাড় দিই। আমার সন্তানেরা বিদেশে পড়েছে, বিদেশেই থাকে। তাদের সব কাজ আমাকেই করে দিতে হয়েছে।

মতিউর: জীবনের কিছু দুঃখজনক অভিজ্ঞতার কারণেই কি আপনি পুরুষদের অপছন্দ করছেন?
কবরী: পুরুষদের আমি অপছন্দ করিনি বা করছি না, এমন নয়। নারী–পুরুষ কারও সঙ্গে কাজ করতেই আমার কোনো সমস্যা নেই, কোনো অভিযোগও নেই, যদি সেই ব্যক্তি  সংবেদনশীল হন।

দেবদাস ছবিতে কবরী ও বুলবুল আহমেদ।
দেবদাস ছবিতে কবরী ও বুলবুল আহমেদ।



মতিউর:
আসলে নারী-পুরুষের একসঙ্গে চলা, পাশে থাকা, বন্ধুত্ব—এটা তো খুব দরকার, নাকি?
কবরী: হ্যাঁ, প্রচণ্ডভাবে দরকার। আমার অভিনয়, সফলতা, উদ্যোগ, চলাফেরা এবং আমার জীবনের উৎসাহ—পুরুষ ছাড়া এসব অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব না। আপনি যাকে ভালোবাসলেন, সে যদি আপনার হৃদয়ে নাড়া না দিতে পারে, তাহলে তো কিছু হয় না। যখন আপনি কাউকে জড়িয়ে ধরবেন, তখন যদি তাকে অনুভব করতে না পারেন, তবে ভালোবাসাটা কোথায়? আপনি যদি ভালোবেসে কাউকে জড়িয়ে ধরেন, সেটা তো যুগ যুগ ধরে মনে থাকবে। জীবনের যেকোনো পর্যায়ে এ স্মৃতি মনে এলে ভালো লাগবেই।

মতিউর: আমরা দেখেছি, সম্পর্ক নিয়ে বিখ্যাত সব মানুষের জীবনেও অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে। মন এক বিরাট বিষয়। এই দীর্ঘ জীবনে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী—কত বিচিত্র মানুষই তো দেখলাম। মনের মিলের জায়গাটিতেই অনেকের সমস্যা থেকে যায়। আপনি যদি কথা না বলতে পারেন, মত বিনিময় করতে না পারেন, সত্য না বলতে পারেন, দুঃখটা ভাগ না-ই করতে পারেন, তাহলে জীবন চলবে কীভাবে?
করবী: মাঝেমধ্যে আমার কী মনে হয় জানেন, অনেকেই সৎ নন। আপনার আমাকে প্রয়োজন। এর মধ্যে তো ছলচাতুরীর দরকার নেই। মানুষ যখন সততার সঙ্গে সবকিছু করে, জীবন তখন সহজ হয়ে যায়। অনেকের মধ্যে এই সততারই বড় অভাব।

মতিউর: অভিনয় আর চলচ্চিত্র—এই নিয়েই তো আপনার জীবন। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ সময়, সুন্দর সময়, আনন্দের সময় কি একেবারেই নেই?
কবরী: আনন্দের সময় তো নিশ্চয়ই আছে। আমি খুব মিশুক। সবার সঙ্গে মিশতে পারি। কারও সঙ্গে মিশতে-চলতে কোনো অসুবিধা হয় না। একেবারে মাটির মানুষের মতোই একাত্মতা অনুভব করতে পারি। ভালোবাসা তো ধরা-ছোঁয়ার বাইরের বিষয়। সেটা শুধু অনুভব করা যায়।

মতিউর: পারিবারিকভাবে মা–বাবা, ভাইবোনসহ আপনার যে জীবন ছিল, সে জীবনটাকে এখন কীভাবে দেখেন?
কবরী: সবকিছুর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার একটা সামঞ্জস্য তৈরি করা আছে। মানুষের জীবনকে তিনি একটা ছকে বেঁধে দিয়েছেন। শৈশবে অভাবের সংসারে কষ্টে ছিলাম। তারপর নিজের কাজের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি, সফল হয়েছি। জীবনে স্বীকৃতি এসেছে। জীবনে আমি শুধু সম্মানটুকু চেয়েছি। টাকাপয়সার কথা কোনো দিন চিন্তা করিনি। এখনো পাঁচ হাজার টাকাও গুনতে গেলে বিরক্তি লাগে। অর্থের লোভ যে আমার নেই, এ জন্য বড় বেঁচে গেছি। তবে এটাও ঠিক যে জীবনের জন্য টাকার প্রয়োজন আছে। টাকা না হলে যে জীবন চলে না। আমার নানা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ছিলেন। আমার বাবা তাঁর মা–বাবার সঙ্গে জীবন কাটিয়েছেন। এখনো মনে পড়ে, অনেক রাতে ফুপির বাড়িতে গেছি একটিমাত্র জুতা পরে। সে জুতাও আবার আমার পায়ের মাপের চেয়ে বড়। হাঁটতে গেলে জুতোটা বের হয়ে যায়—এমন অবস্থা। কিছুদিন পরই বড় হয়ে যাব বলে আমাকে বড় জুতা কিনে দেওয়া হয়েছিল। তো, ফুপির বাড়ি গিয়ে কই মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছি। তাঁদের ডুলার ভেতরে ডাল ছিল। সেই স্মৃতি আমার এখনো মনে পড়ে। আজকাল কেবলই মনে হয়, ওই জীবনটাই বোধ হয় সত্যিকারের জীবন ছিল। সে এক আনন্দের জীবন ছিল আমার! তবে আজকে যেমন করে ভাবি, সে সময় তো তেমন করে ভাবতে শিখিনি।

মতিউর: সিনেমাজগৎ থেকে কী পেলেন? এই জগৎটাকে কীভাবে দেখেন আপনি?
কবরী: সিনেমা থেকে অনেক অনেক কিছু পেয়েছি। একটু ব্যাখ্যা করে বললে বলব, সিনেমা থেকে নতুন জীবন পেয়েছি। যে মিনা পালকে কেউ চিনত না, সেই মিনা পাল এখন বিশ্ববাসীর কাছে ‘কবরী’ নামে পরিচিত হয়েছে। নতুন বিয়ে করা স্ত্রীকে তার স্বামী সিনেমা হলে নিয়ে গিয়ে সুতরাং দেখিয়েছে। সে তার স্ত্রীকে সুতরাং-এর ‘জরিনা’কে উপহার দিয়েছে।

ফিরিঙ্গি বাজারের সেই মিনা পাল একজন সাংসদ হয়ে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত পৌঁছেছে। আর কী চাই।

মতিউর: আপনি ছবি পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন। এ পর্যন্ত কয়টি ছবি করলেন?
কবরী: প্রযোজনা করেছি মোট তিনটি ছবি—বলাকা মন, শীত বসন্তগুন্ডা। আর ছবি পরিচালনা করেছি দুটো—মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র একাত্তরের মিছিল, আর পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আয়না। আয়না ছবিটি করেছিলাম অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের নিয়ে। ছবিটি ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’-এ সেরা ছবির পুরস্কার পেয়েছিল। সৈয়দ শামসুল হক সেবার জুরিবোর্ডের সভাপতি ছিলেন।

মতিউর: আপনার ছবির প্রথম নায়ক সুভাষ দত্তকে আপনি কেমন দেখেছেন?
কবরী: দাদা আমার গুরু, নমস্য ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন আপনভোলা মানুষ, নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। মাঝেমধ্যে তাঁর বাড়িতে মহড়া দিতে যেতাম। বউদি আমাকে ভীষণ আদর করতেন। তিনি ভালো রান্না করতেন। আমি পাশে বসে অবাক হয়ে তা দেখতাম। দাদা–বউদির কথা মনে এলে অনেক স্মৃতিই মনে পড়ে। একবার দাদার বাড়িতে মহড়া করতে গিয়ে দুই–তিন দিন ছিলাম। তাঁর বাড়ি ছিল পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে। ওই এলাকায় ছিল বানরের উপদ্রব। একদিন দুপুরবেলা বউদি হাঁড়িপাতিল ধুয়ে সবে বারান্দায় রেখেছেন, এর মধ্যে বানরের দল এসে সেগুলো নিয়ে এক লাফে উঠে গেল গাছে। তখন হাড়িপাতিল ফিরে পাওয়ার জন্য তাদের কাছে বউদির কী কাকুতি–মিনতি। বানরদের এটা সাধেন, ওটা সাধেন। শেষ অবধি তাদের কলা দেওয়ার পর হাঁড়িপাতিল ফিরে পাওয়া গেল। আসলে দাদা–বউদির কাছে আমার কত যে ঋণ! দাদা তো আমার শিক্ষক ছিলেন। শব্দের উচ্চারণ বলে দিতেন। প্রতিটি কাজের নির্দেশনা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। আমার বুদ্ধি, জানাশোনা, ভালো-মন্দ বোঝা—সবই দাদার অবদান। একবার দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নায়িকা হিসেবে আমাকে তিনি কেন পছন্দ করেছিলেন? আমার তো পটলচেরা চোখ ছিল না। নাকটাও খাড়া নয়। দাদা বললেন, তোমার নতুন দাঁত উঠেছিল তো। তাতে তোমার হাসিটা চমৎকার ছিল। ওই ঢেউখেলানো দাঁতের হাসির জন্যই তোমাকে নিয়েছি।

ময়নামতি ছবিতে রাজ্জাক ও কবরী।
ময়নামতি ছবিতে রাজ্জাক ও কবরী।



মতিউর:
আপনার সময়কালে সিনেমাজগতে প্রতিভাবান হিসেবে আপনি কাদের নাম করবেন?
কবরী: আতা ভাই (খান আতাউর রহমান)। আমার দেখা খুব ভালো একজন মানুষ। খুব গুণীও। সিনেমা, গল্প, গান লেখা, সুর করা, বাংলা-ইংরেজি চিত্রনাট্য লেখা এবং পরিচালনা—সবকিছুতেই তাঁর ছিল অসাধারণ দক্ষতা। তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। বিভিন্ন সময়ে আমার কাছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গল্প করতেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি ‘মুজিব ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। তাঁর মৃত্যুকে সহজভাবে নিতে পারেননি তিনি। দেখেছি, বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে বলতে তিনি অঝোরে কেঁদে ফেলতেন। বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন সব সময়। একসময় তাঁর জীবন কিছুটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কিছুই ঠিকভাবে সামাল দিতে পারছিলেন না। শেষের দিকে আমার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল। আতা ভাই ছাড়া আরও ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক, কাইয়ুম চৌধুরী, আনিস চৌধুরী। এঁদের মতো প্রতিভাবান মানুষের মধ্যেই আমি বড় হয়েছি।

মতিউর: সেই সময়ের সেরা পরিচালক হিসেবে কাকে স্মরণ করবেন আপনি?
কবরী: খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, জহির রায়হান, মহিউদ্দীন, ফজলে লোহানী, মিতাসহ আরও অনেক গুণী পরিচালকের নাম আমাকে করতে হবে। তাঁদের পরে চাষী নজরুল ইসলাম, আমজাদ হোসেনসহ আরও কয়েকজন পরিচালকও স্বকীয়তা নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁদের মতো তেমন কাউকে আর পরবর্তী সময়ে চোখে পড়েনি।

মতিউর: আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে নাটক আর সিনেমা দুটোই করেছেন। তিনি কেমন ছিলেন?
কবরী: ভীষণ গুণী একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর সিনেমা ও নাটকে আমি কাজ করেছি। তিনি ভীষণ রোমান্টিকও ছিলেন।

মতিউর: শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাস সারেং বৌ অবলম্বনে তৈরি করা ছবিতে আপনি কাজ করেছেন। তাঁকে কেমন দেখেছেন?
কবরী: শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তকসারেং বৌ দুটো উপন্যাস নিয়ে তৈরি সিনেমা ও টেলিভিশন নাটকে আমি কাজ করেছি। একাত্তরের শুরুর দিকে সংশপ্তক নাটকটি করার সময় টেলিভিশনের সেটে শহীদুল্লা কায়সারকে প্রথম দেখি। তিনি চুপ করে বসে থাকতেন। সে সময়ই তিনি একদিন মামুন ভাইকে বললেন, ‘মামুন, তুমি যদি সারেং বৌ করো, কবরী কিন্তু সারেংয়ের বউ হবে।’ তাঁর কথা শুনে মামুন ভাই সেদিন মিষ্টি করে হেসে বলছিলেন, ‘তাই!’ পরে তো সেই ছবির ‘নবিতুন’ চরিত্রের জন্য কী প্রতিযোগিতা! শাবানা, ববিতা, আমি। শেষ পর্যন্ত আমাকেই নির্বাচন করা হলো।

মতিউর: ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম ছবিতে কাজ করেছেন।
কবরী: সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা—এঁরা তো অসাধারণ। তবে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে আমি সরাসরি কাজ করেছি। সেই অভিজ্ঞতা সত্যিই অপূর্ব। তাঁর কাছে কোনো কাগজপত্র থাকত না। সবই তাঁর মাথায় আর মুখে থাকত। অনেক উঁচু মাপের পরিচালক ছিলেন তিনি।

মতিউর: আপনার সময়ের ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম বলতে বললে আপনি কাদের নাম বলবেন?
কবরী: অভিনেতা হিসেবে শ্রেষ্ঠ ছিলেন আতা ভাই। তাঁর মাপের অভিনেতা সে সময় খুব কমই ছিলেন। আর অভিনেত্রীদের মধ্যে সুমিতাদি (সুমিতা দেবী) ছিলেন দারুণ।

মতিউর: আপনার সময়ের নায়ক ও নায়িকাদের মধ্যে কাকে ভালো বলবেন?
কবরী: নায়কদের মধ্যে রাজ্জাক ছিলেন অতুলনীয়। অভিনেতা হিসেবে ছিলেন সবার চেয়ে সেরা। আমাদের সম্পর্কটাও ছিল অনেক সুন্দর। তাঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাও ছিল মধুর। বিশেষ বিশেষ চরিত্রে জাফর ইকবাল আর ফারুকও খুবই ভালো ছিলেন। আলমগীরও অনেক মেধাবী। চরিত্র ও অভিনয়টা বোঝার চেষ্টা করেন। শাবানার সঙ্গে ওর জুটি ছিল। আরেকজন খুব ভালো অভিনেতা ছিলেন গোলাম মুস্তাফা। আজিম ভাই ছিলেন ভালো মানুষ। অভিনেতা হিসেবে রহমানও ছিলেন দারুণ। বুলবুল ভালো অভিনয় করত। পুরোনো দিনের কথা বলতে গিয়ে অনেক কিছুই তো মনে পড়ে যায়। যেমন মনে পড়ছে শবনমের কথা। মালা, চান্দা, তালাশ ছবিতে কী চমৎকার অভিনয় করেছেন! সুলতানা জামান, সুচন্দা, সুজাতাসহ আরও অনেকেই ভালো অভিনয় করতেন।

মতিউর: ১৯৫৬ সাল থেকে আমি ছবি দেখা শুরু করেছি। ইতালি, ফ্রান্স, মুম্বাই, কলকাতা, লাহোরসহ বিভিন্ন দেশের সিনেমা দেখতাম। হলিউডের ছবিও চলত। এরপর জহির রায়হান, সুভাষ দত্ত, খান আতাউর রহমান—এঁদের ছবি দেখেছি। এই সময়ে আপনাদের উত্থান। সেসব ছবির পাশাপাশি কিন্তু আপনাদের ছবিও ভালো ব্যবসা করেছে। সবকিছু খোলা থাকলে শেখার সুযোগও বেশি থাকে। এখন যে বিদেশি সিনেমা বন্ধের কথা বলা হয়, এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
কবরী: স্বাধীনতার পরও যদি দেখেন, তখনো কিন্তু দেশে অনেক ভালো ছবি হয়েছে। রংবাজ, ওরা ১১ জন, আবার তোরা মানুষ হ—এগুলো ছবি হিসেবে, আবার ব্যবসাতেও সফল। আগের ভালো পরিচালকদের কোনো উত্তরসূরি তৈরি হয়নি। শুধু চলচ্চিত্র তো নয়, সবকিছুতেই একটা ধস নেমেছে। বঙ্গবন্ধুর সময়ের মতো মানুষেরা তো পরবর্তী সময়ে তেমন আর আসেননি। ওই সময়কার কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের মতো গুণী মানুষ তো এখন আর আপনি পাবেন না। প্রায় সব ক্ষেত্রে একটা মেধাশূন্যতা চলছে। পরিচালকদের মধ্যে শেষ যে দুই নক্ষত্র ছিলেন—চাষী নজরুল ইসলাম ও আমজাদ হোসেন—তাঁরাও চলে গেলেন। কেন এই অবক্ষয়? আমার মনে হয়, রাজনীতি সবকিছু খেয়ে ফেলেছে। দেশটা যেভাবে তৈরি হওয়ার কথা, সেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। আমাদের সময়ে বিদেশি ছবির মধ্যেও আমাদের ছবি ব্যবসা করত। কেন? কারণ আমাদের নিজেদের জীবন ও সংস্কৃতির প্রবল উপস্থিতি সেখানে ছিল।

মতিউর: এই যে বললেন সর্বক্ষেত্রে ধস, সেখান থেকে ফিরে আসার উপায় কী?
কবরী: আমি নিজেও জানি না, কেমন করে ফিরে আসব। কে কাকে ধংস করবে, কে কার কাছে অস্ত্র বিক্রি করবে—এই নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটা অস্থিরতা চলছে। জঙ্গিবাদ তৈরি করেছে আরেকটা অস্থিরতা। বাংলাদেশকে নিয়ে চীন বা যুক্তরাষ্ট্র কী ভাবছে? জটিলতার তো শেষ নেই। আমাদের এই ছোট্ট দেশে প্রায় প্রতিনিয়ত ধর্ষণসহ বড় বড় অন্যায়-অবিচারের ঘটনা ঘটছে। অথচ আমরা সবাই যেন গর্তের মধ্যে ঢুকে আছি। কারও কাছ থেকে কোনো প্রতিবাদ আসছে না। শিল্প-সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সংস্কৃতি—সবই যেন গর্তের ভেতরে ঢুকে আছে। এ অবস্থায় আপনি কী করবেন? কী বলবেন? আমি মনে করি, আমরা যত বেশি কথা বলব, তত বেশি উত্তরণ ঘটবে আমাদের। আর যত বেশি লুকিয়ে থাকব, তত বেশি গর্তের মধ্যে পড়ে যাব। যাঁরা যে ক্ষেত্রে ভালো কাজ করেন বা করছেন, তাঁদের সামনে আসার সুযোগ করে দিতে হবে। আমাদের লড়াই করতে হবে। লড়াই ছাড়া মুক্তি নেই, এবং সেটা সর্বক্ষেত্রে।

মতিউর: ভারতীয় নাটক-সিনেমা বাংলাদেশের জন্য কতটা দরকারি বা ক্ষতিকর বলে মনে হয় আপনার কাছে?
কবরী: ভারতের বর্তমান নাটক বা সিনেমার প্রশংসা তো আমি করতে পারব না। বাংলাদেশ থেকে এখন ভারতের যেসব টিভি-নাটক দেখা যায়, সেগুলো তো অসম্ভব ক্ষতিকর। এসব নাটক-সিরিয়ালে কেবল হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া, রেষারেষির ছড়াছড়ি। নান্দনিক কিছুই নেই। ভারতীয় সিনেমাগুলোও আগের সেই মান ধরে রাখতে পারেনি। এ ধরনের ভারতীয় সিনেমা আমি দেখতে চাই না।

মতিউর: আত্মস্মৃতিতে আপনি লিখেছেন, মেয়েরা পুরুষের প্রতি বেশি সিনসিয়ার হয়, কারণ সমাজে এখনো কর্তৃত্বের প্রথা রয়ে গেছে। নারীরা কি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পুরুষদের প্রাধান্য দেবে, নাকি নিজেই তার অধিকার আদায় করে নেবে?
কবরী: আমি মনে করি, একটা সম্পর্কে দুজনেরই সমান অবদান থাকতে হয়। একতরফা কোনো কাজই ভালোমতো হয় না। আমার মতে, কোনো সম্পর্ক টিকে থাকা বা ভাঙার ব্যাপারে নারী-পুরুষ দুজনেরই সমান অবদান থাকে।

সারেং বৌ ছবিতে কবরী ও ফারুক।
সারেং বৌ ছবিতে কবরী ও ফারুক।



মতিউর:
আপনি আরও লিখেছেন, জীবন আসলে একটা যুদ্ধক্ষেত্র। আপনার জীবনের অভিজ্ঞতায় নিজের জীবনযুদ্ধকে আপনি কীভাবে দেখেন?
কবরী: জীবনে যুদ্ধ করেই সামনের দিকে এগিয়েছি, সফল হয়েছি। এ জন্য অনেক ঘাত-প্রতিঘাতও অতিক্রম করতে হয়েছে আমাকে। আমার জীবনে দুঃখ আছে, বেদনা আছে, আবার আনন্দও আছে।

মতিউর: আপনার জীবনের একটি ঘটনা আমি পড়েছি। আপনি তখন খুব ছোট। আপনাদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে সম্পর্কিত একজন মানুষ আপনার মাকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, ‘মিনাকে আমি বিয়ে করতে চাই।’ সে ঘটনাটি সম্পর্কে কিছু বলুন?
করবী: (প্রশ্ন শুনে হাসি) ওহো, সে তো অনেক পুরোনো কথা। তাঁর নাম অসীম নন্দী। তাঁর এক মেয়ের জামাই প্রথম আলোতে কাজ করে। তার মাধ্যমেই অসীম নন্দীর সঙ্গে একবার ফোনে কথা হয়। আমি বললাম, দাদা, আপনি ঢাকায় আসেন না? তিনি বললেন, যাই তো। আমি বললাম, এলে তো দেখা হতো। ফোনে তিনি নানান খুনসুটি করলেন। বললেন, তুমি তো এখন বুড়ো হয়ে গেছ। আমিও কম যাইনি। বলেছি, আপনি বুঝি খুব যুবক আছেন? যা–ই হোক, পরে অবশ্য তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। দেখা হওয়ার সেই ঘটনাটা এত নাটকীয় ছিল যে সেটা নিয়ে একটা সিনেমা বানানো যায়।

আমার কাছে একবার চট্টগ্রামের ফতেহাবাদের একটা স্কুল উদ্বোধনের আমন্ত্রণ এল। ফতেহাবাদ শুনেই চমকে উঠলাম। কারণ সেখানেই অসীম নন্দীর বাড়ি। কেন যেন মনে হলো, সেখানে গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। আমার কথা শুনলে তিনি নিশ্চয়ই আসবেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম।

অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি, তিনি আসেননি। তাঁর ছেলে এসে দেখা করে জানাল, বাবা অসুস্থ। তিনি আমাকে তাঁর বাড়িতে একবার যেতে অনুরোধ করেছেন। অনুষ্ঠান শেষ করে তাঁর বাড়ি গেলাম। কত বছর পর দেখা! দারুণ ছিল সেই দেখা হওয়ার মুহূর্তটা। তাঁর স্ত্রী-কন্যারা সবাই উপস্থিত। অসীম নন্দী যে আমাকে পছন্দ করতেন বা বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, পরিবারের সবাই সে কথা জানেন। আমরা এক খাটে বসলাম। অনেক কথা হলো, গল্প হলো। তাঁর এক মেয়ে ছোটবেলার সেই গল্পটা শুনতে চাইলে, বকুনি দিয়ে ওকে থামিয়ে দিলাম। আস্তে আস্তে ফিরে আসার সময় হয়ে এল। সেখান থেকে ফিরে আসার কিছুদিন পর থেকে আমার মোবাইলে অসীম নন্দীর নম্বর থেকে অনবরত ফোন আসতে লাগল। আমি আর ধরি না। তিনি আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন, দেখা করেছি। এরপর আবার ফোনে কথা চালিয়ে যাওয়া—এসব ভালো লাগছিল না। কিছুটা বিরক্ত হয়েই শেষে একবার ফোনটা ধরলাম। আমি কিছু বলার আগেই ওই পাশ থেকে একজন বলল, ‘আন্টি, আপনি যাওয়ার পরে বাবা মারা গেছেন!’ আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তার কথা শুনে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। জানতে চাইলাম, কী হয়েছিল? বলল, ‘জানি না। আপনার সঙ্গে দেখা হলো, হইচই করল, গল্প করল। ঠিক তার কয়েক দিন পর বাবা মারা গেছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যই বোধ হয় বাবা অপেক্ষা করছিলেন।’ কী আশ্চর্য! ঘটনাটা এখনো আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়।

মতিউর: আপনি শিক্ষকতার মহান পেশা বেছে নিতে চেয়েছিলেন। ব্যাগ ঝুলিয়ে শাড়ি পরে বিদ্যালয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু হয়ে গেলেন অভিনয়শিল্পী। অভিনয় করে খ্যাতি পেলেন, স্বীকৃতিও। সিনেমা প্রযোজনা ও পরিচালনা করছেন। সাংসদ হয়েছেন। সফলতার এই পর্যায়ে এসে জীবনটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
কবরী: মানুষ যখন প্রশংসা করে, তখন মনে হয় কিছু হয়তো করেছি। আবার কোনো কারণে কেউ ভুল বুঝলে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। তাদের বলতে চাই, হয়তো তারা আমাকে ভুল বুঝেছে। আসলে এক জীবনে তো আর সবকিছু পাওয়া যায় না। আমিও সবকিছু পাইনি। আবার সবকিছু দিতেও পারিনি, যদিও আমার দেওয়ার মতো অনেক কিছুই ছিল। জীবনের হিসাব-নিকাশ নিয়ে তেমন করে কখনো বসা হয়নি। যখন মানুষ প্রশংসা করে, সে সময় মনে হয় জীবনে কিছু হলেও তো করেছি।

এখন মনে হয়, আমার বয়সটা যদি আরও কম হতো, তাহলে আরও অনেক কিছু করতে পারতাম। নতুন করে জীবনটা শুরু করতে পারতাম। দেশকে আরও বড় কিছু হয়তো দিতে পারতাম।

আমি খুব চাই, আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের দ্রুত উন্নতি হোক। হ্যাঁ, জানি, চাইলেই রাতারাতি সিনেমার অতীত ঐতিহ্যের মতো সুদিন ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিন্তু ধীরে ধীরেও কি সেটা সম্ভব নয়? ধীরে ধীরে হলেও সুদিন ফিরে আসুক না।

নিজেকে নিয়ে এখন আমার আর কোনো দুর্ভাবনা নেই। আমি চাই, আমার সন্তানেরা যেন আমার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করে। আমার অপূর্ণতাগুলো যেন তারা পূরণ করতে পারে। আমার আশা-আকাঙ্ক্ষা, পাওয়া না-পাওয়া—সবটা তো সিনেমাজুড়েই। আমি চাই প্রতিনিয়ত ভালো ভালো ছবির শুভমুক্তি ঘটুক। সোনালি অতীত আবারও ফিরে আসুক—নতুন আঙ্গিকে, নতুন করে।