আজ গুরুর চলে যাওয়ার দিন

আজম খান, ২০১১ সালের ৫ জুন তিনি মারা যান। ফাইল ছবি
আজম খান, ২০১১ সালের ৫ জুন তিনি মারা যান। ফাইল ছবি

‘একে একে চলিয়া যাবে সবাই, তুমিও যাবে আমিও যাব, মিছে ভাব তাই’—মাইক্রোফোন হাতে মঞ্চে যে মানুষটি দাঁড়ালেই হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ত অগণিত মানুষ, আজ সেই মানুষটির স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার দিন। আজ ৫ জুন, বাংলা পপ গানের কিংবদন্তি আজম খানের মৃত্যুবার্ষিকী। আট বছর আগে ২০১১ সালের এই দিনে সকাল ১০টা ২০ মিনিটে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে পৃথিবীর বাতাসে শেষবার নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬১ বছর। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ চলছিল দেশের জন্য অস্ত্র হাতে নেওয়া মানুষটির। ক্যানসারের সঙ্গে এক বছরেরও বেশি সময় লড়েছিলেন, সে যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়ে যাওয়ার আগে তিনি দুটি জিনিস রেখে গেছেন—স্বাধীন দেশ ও মানচিত্র আর অন্যটি বাংলা রক গান।

বাংলাদেশের ‘পপগুরু’ আজম খান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে এক বড় আদর্শ। বেশির ভাগ রক সংগীত অনুরাগীর মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এখন যে বাংলা রক ও ব্যান্ডের গান হচ্ছে, তার যাত্রা হয়েছিল এ মানুষটির হাত ধরে। একসময় ব্যান্ড মিউজিক ছিল বসার ঘরে। তাকে সবার সামনে নিয়ে আসায় নেতৃত্ব দেন আজম খান। জনপ্রিয় করে তোলেন এই ধারাকে। আজম মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব ও পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষোভ-আনন্দ, প্রেম-বেদনা, জীবন-মৃত্যুর অনুভব—সবকিছু অবলীলায় তাঁর সংগীতের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। ব্যক্তিসত্তার ঊর্ধ্বে উঠে একজন শিল্পী কীভাবে নিজেই একটি ঘটনা হয়ে যান, আজম খান তাঁর উদাহরণ।

খুব সাধারণ ছিলেন অসাধারণ মানুষটি
রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় কবি জসীমউদ্‌দীন রোডে, মতিঝিলের ব্যাংক কলোনি মাঠে কিংবা স্টেডিয়ামের সুইমিংপুলে যারা আজম খানকে দেখেছেন, তাঁরা জানেন, বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ব্যক্তিজীবনে শিল্পী আজম খান কতটা সহজ-সরল ছিলেন। খোলা মনের মানুষ ছিলেন। সহশিল্পী বা সংগীতজগতের মানুষেরাও প্রমাণ পেয়েছেন বারবার। কবি জসীমউদ্‌দীন রোডে বাবার রেখে যাওয়া বাড়িতেই থাকতেন সন্তানদের নিয়ে। অনেকটা নিভৃতে, অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। গান করতেন, ক্রিকেট খেলতেন। সুইমিংপুলে গিয়ে সাঁতার শেখাতেন। মানুষকে আকর্ষণ করার প্রবল ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে।

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আজম খান। ছবি: সংগৃহীত
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আজম খান। ছবি: সংগৃহীত

তাঁর গানগুলো যেন ছিল তাঁর সহজ–সরল জীবনের কোরাস। ‘আলাল দুলাল’, ‘সালেকা মালেকা’, ‘রেললাইনের বস্তির ছেলে’র কথা তুলে ধরে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলা গানে সমাজের নিচুতলার অতি সাধারণ মানুষকে উপস্থাপন করেছিলেন। এসব সাধারণ মানুষ, তাঁর ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর এবং সংগীত পরিবেশনার একান্ত আপন আঙ্গিক তাঁকে দ্রুত জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। বিশেষ করে, ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে জন্মে ছিল একটি ছেলে/ ছেলেটি মরে গেছে/ মা তার কাঁদে/ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানটি শ্রোতাদের হৃদয়ে তাঁর জন্য স্থায়ী আসন তৈরি করে দেয়।

তাঁর স্মৃতিচারণা করে বন্ধু সহযোদ্ধা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘আজম খান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সাংস্কৃতিক জগতে একজন বিস্ময়কর ব্যক্তি। এই আজম খানের বেড়ে ওঠার সময়ের একজন সাক্ষী আমি। ষাটের দশকে কৈশোর ও যৌবনের আবেগদীপ্ত সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি আমরা কজন ঢাকার বন্ধু। আজমের সারল্য আমাকে কৈশোরেই আকৃষ্ট করেছিল। আমাদের ছাত্রজীবন কেটেছে আন্দোলনে-সংগ্রামে। একটি জাতির স্বাধীন হওয়ার প্রক্রিয়ায় আমরা সবাই জড়িয়ে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আজম মেলাঘরে পাহাড়ের পাদদেশে টিনের বাসন ও চামচ দিয়ে তাল ঠুকে গান গাইতেন—সঙ্গে ছিল অনেক তরুণ যোদ্ধা। এ দৃশ্য ভোলার না!’

আজিমপুর থেকে শুরু
আজম খানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুরের সরকারি কোয়ার্টারে। প্রকৃত নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। বাবা আফতাব উদ্দিন খান সরকারি চাকরিজীবী। মা জোবেদা বেগম সংগীতশিল্পী। ছেলেবেলা থেকেই সংগীতে অনুরাগ। মায়ের অনুপ্রেরণায় নিয়মিত সংগীতচর্চা। ১৯৬৬ সালে তিনি সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৮ সালে টিঅ্যান্ডটি মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন।

আজম খান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সাংস্কৃতিক জগতের একজন বিস্ময়কর ব্যক্তি। ছবি: সংগৃহীত
আজম খান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সাংস্কৃতিক জগতের একজন বিস্ময়কর ব্যক্তি। ছবি: সংগৃহীত

দেশে তখন আইয়ুব খানবিরোধী উত্তাল আন্দোলন। সক্রিয়ভাবে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। জনতার আন্দোলনকে বেগবান করতে ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’র সদস্য তরুণ আজম খান গণসংগীত গেয়ে পথে নামেন। তারপর শুরু হয় বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্র চলে যান আগরতলায়। একদিকে নিয়েছেন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ, অন্যদিকে প্রশিক্ষণ শিবিরে গান গেয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্র হাতে অংশ নিয়েছেন সম্মুখসমরে। দেশমাতৃকার পরাজয়ের শৃঙ্খল মুক্ত করে বীরের বেশে ফিরেছেন প্রিয় ঢাকায়।

প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সেই যে ছেদ পড়েছিল, তা আর এগোয়নি। সংগীতে যে অনন্য প্রতিভা ছিল তাঁর, সেটিকেই সাধনার পথ ও জীবিকার উপায় হিসেবে আঁকড়ে ছিলেন আমৃত্যু। পশ্চিমা ধাঁচের পপগানে দেশজ বিষয়ের সংযোজন ও পরিবেশনার স্বতন্ত্র রীতিতে বাংলা গানে নতুন মাত্র এনেছিলেন তিনি। শ্রোতাদের কাছে তখন এ ধরনের গান ছিল একেবারেই নতুন। লেখা বাহুল্য, এই নতুন ধারার গানের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি শ্রোতাদের কাছে ‘পপসম্রাট’ বা ‘পপগুরু’ হিসেবে সম্মানিত হন।

মুক্তিযোদ্ধা আজম খান
১৯৭১ সালে আজম খানের বাবা আফতাব উদ্দিন খান সচিবালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন। বাবার অণুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন তিনি। জীবনকালে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে সঙ্গে আলাপকালে স্মৃতিচারণা করেছিলেন তিনি। যুদ্ধ যাওয়ার সময় মা বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে যাচ্ছিস যা, দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না।’ সেবার তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে, তিনি হেঁটে আগরতলা চলে যান। আগরতলার পথে সঙ্গী হন তাঁর দুই বন্ধু। এ সময় তাঁর লক্ষ্য ছিল সেক্টর ২-এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগ দেওয়া। আজম খান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ২১ বছর বয়সে।

আজম খানের অ্যালবামের কভার
আজম খানের অ্যালবামের কভার

আজম খানের গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ জোগাত। তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের মেলাঘরের শিবিরে। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে অংশ নেন। কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি আবার আগরতলায় ফিরে আসেন। এরপর তাঁকে পাঠানো হয় ঢাকায়, গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইনচার্জ। আর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ। সেকশন কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশপাশে কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত ‘অপারেশন তিতাস’।

মুক্তিযুদ্ধের পর ক্রমে আজম খান হয়ে ওঠা
সংগীতে, নাটকে, কবিতায় যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তখন রেনেসাঁ যুগ। নতুনের অনিবার্য আহ্বান—নতুন পথের নতুন ঠিকানার। আজম খান গিটার হাতে তাঁর অননুকরণীয় কণ্ঠস্বরে বন্ধুদের নিয়ে যে সংগীতের দল গড়লেন, তার নাম ‘উচ্চারণ’। ১৯৭২ সালে ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়। সে বছরই বিটিভিতে প্রচারিত ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ আর ‘চার কলেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। এরপর ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’, ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘হারিয়ে গেছে খুঁজে পাব না’—এসব গানে গানে তিনি শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলেন। ‘এক যুগ’ নামে তাঁর প্রথম অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। সব মিলিয়ে তাঁর গানের অ্যালবাম ১৭টি। জনপ্রিয় অন্যান্য গানের মধ্যে আছে ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছু রবে না রে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে, ‘জীবনে কিছু পাব না’, ‘পাপড়ি কেন বোঝে না’, ‘সাঁইজি’, ‘সব মানুষই সাদা কালো’, ‘মানুষ নামে খেলনা’, ‘জীবনের শেষ কটা দিন’, ‘অনামিকা’, ‘অভিমানী’ এসব। এভাবে ক্রমে আজম খান হয়ে উঠছেন তিনি। সত্তর ও আশির দশকের এমন কোনো ব্যান্ড এবং শিল্পী পাওয়া যাবে না, যাঁরা আজম খানের গান করেননি।

গানের ভুবনের বাইরে
গানের মতোই দারুণ খেলাধুলার প্রতি ছিল তাঁর দারুণ ভালোবাসা। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালে তিনি গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষ হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলতেন।

২০০৩ সালে গডফাদার নামের একটি বাংলা চলচ্চিত্রেও আজম খান অভিনয় করেন। কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হয়েছেন। সংগীতের পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। সাঁতারের প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ‘গডফাদার’ নামে একটি বাংলা সিনেমায় ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এ ছাড়া তিনি কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হয়েছেন।

আজম খানের বড় ভাই সাইদ খান (সরকারি চাকরিজীবী), মেজ ভাই আলম খান (সুরকার), ছোট ভাই লিয়াকত আলী খান (মুক্তিযোদ্ধা) এবং ছোট বোন শামীমা আক্তার খানম। ১৯৮১ সালে তিনি সাহেদা বেগমকে বিয়ে করেন। তাঁর দুই মেয়ে ইমা খান ও অরণি খান এবং ছেলে হৃদয় খান।