বদলে যাচ্ছে থিয়েটার চর্চা

সংগীতা চৌধুরী ও রামিজ রাজু অভিনীত থিয়েটারওয়ালা রেপার্টরির জবর আজব ভালোবাসা নাটকটি তিনজন অভিনয়শিল্পীকে নিয়ে তৈরি হয়েছে
সংগীতা চৌধুরী ও রামিজ রাজু অভিনীত থিয়েটারওয়ালা রেপার্টরির জবর আজব ভালোবাসা নাটকটি তিনজন অভিনয়শিল্পীকে নিয়ে তৈরি হয়েছে

নগরকেন্দ্রিক থিয়েটার চর্চায় পরিবর্তন আসছে। বড় পরিসরে নাটক তৈরির বদলে অল্প পরিসরে, অল্প লোক নিয়ে প্রযোজনা তৈরির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নিয়মিত থিয়েটার চর্চার পরিবর্তে প্রদর্শনীকেন্দ্রিক মহড়ায় অংশগ্রহণ বেশি অভিনয়শিল্পীদের। কারণ হিসেবে নাট্যকর্মীদের কথায় উঠে এসেছে প্রযুক্তির উন্নয়নে নানা মাধ্যমে সময় ব্যয়, নগরকেন্দ্রিক ব্যস্ততা, যানজট, এক এলাকাকেন্দ্রিক থিয়েটার হলসহ নানা কিছু।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে থিয়েটার ছিল তরুণদের সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম বাহন। সে সময় থিয়েটারের মাধ্যমে তরুণেরা একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক–জীবন যাপনের অভ্যাস গড়ে তুলেছিল। কিন্তু নগরকেন্দ্রিক ব্যস্ততায় থিয়েটারে নিয়মিত সময় দিতে পারছে না বর্তমান তরুণেরা। যার কারণে থিয়েটার চর্চা পাল্টে যাচ্ছে ক্রমেই। বটতলা নাট্যসংগঠনের সৃজনশীল পরিচালক মোহাম্মদ আলী হায়দার স্মৃতিচারণা করেন সেই সময়ের কথা। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন নব্বইয়ের দশকে থিয়েটার শুরু করি, তখন প্রতিটি দলে নিয়মিত থিয়েটার চর্চা ছিল। সবাই দলে আসত। এক ঘণ্টা গানের চর্চা, দেহ চর্চা হতো। তারপর নাটকের মহড়া। এখন শুধু প্রদর্শনীকেন্দ্রিক মহড়া হয়। যেহেতু যানজট, কাজকর্ম বেড়েছে, এত টেলিভিশন–রেডিও, যার কারণে সবাই অনেক ব্যস্ত। তাই প্রদর্শনীকেন্দ্রিক চর্চা ছাড়া এখন আসলে সে রকম কোনো থিয়েটার চর্চা হয় না।’

তবে এই থিয়েটার চর্চার পরিবর্তন যে শুধু অভিনেতা–অভিনেত্রীদের ওপরই প্রভাব ফেলেছে, তা নয়। এই প্রভাব পড়েছে দর্শকের ওপরও। ব্যস্ততা ও যানজটের কারণে দর্শকও ঠিকঠাকভাবে আসতে পারছেন না মিলনায়তনে। নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই থিয়েটার চর্চার ধরনে পরিবর্তন এসেছে। একদিকে যেমন আমাদের অভিনেত্রী–অভিনেতাদের সংকট হয়, তেমনি দর্শকেরও সংকট হয়। দর্শক যে কমে গেছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো যানজট। এ ছাড়া জীবনযাত্রা অনেক কঠিন হয়েছে, যারা নাটক করি ও যারা দেখি, উভয়েরই।’

নাট্যকার ও নির্দেশক শুভাশিস সিনহার মতে, নাগরিক জীবনযাপনে চাকরির ধরনগুলো পাল্টে গেছে। আগে যেমন একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করে সন্ধ্যার দিকে সবাই থিয়েটারের চর্চায় অংশ নিতে পারত। কিন্তু চাকরির অনির্দিষ্ট সময় বণ্টনের কারণে নিয়মিত একই সময়ে থিয়েটারে সময় দেওয়াটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া কাজের সময়ের বাইরে আরও অতিরিক্ত কাজ করতে হচ্ছে।

এসব কারণে থিয়েটার চর্চার পরিবর্তন হচ্ছে দিন দিন। নাট্যকর্মীদের কথায় যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে সেগুলো এমন—বেশি অভিনয়শিল্পী নিয়ে কাজ করার বদলে কম অভিনয়শিল্পী নিয়ে কাজ করার প্রবণতা বাড়ছে। নিয়মিত মহড়ায় অংশগ্রহণের বদলে নাটকের প্রদর্শনীকেন্দ্রিক মহড়ার চর্চা বেড়েছে। সময় কম থাকার করণে সব অভিনয়শিল্পীকে একসঙ্গে পাওয়া যায় না। তাই প্রদর্শনীর আগেই দুই থেকে তিন দিন মহড়া করে নাটক প্রদর্শনী করা হচ্ছে। যার কারণে ভালো অভিনয়শিল্পী বের হচ্ছে না। ভালো মানের প্রযোজনা করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তরুণ নির্দেশক বাকার বকুল বললেন, ‘থিয়েটার চর্চায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শুধু এটাই না, মানুষের সময়ও কমে গেছে। তাঁর হাতের মধ্যে প্রযুক্তি আসাতে সে আর নিয়মিত থিয়েটারের চর্চার মধ্যে নেই। থিয়েটার এমন একটা চর্চা, যেটা শিল্পের একটি জীবনযাপন। সেটা করার সময় পাওয়া যাচ্ছে না। অভিনয়শিল্পীরা বিচ্ছিন্নভাবে থিয়েটার করছে।’

মহড়ার সুবিধার্থে অল্প অভিনয়শিল্পী নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক নির্দেশক সাইফ সুমন। তিনি বলেন, ‘সময় বের করাটা একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে আমি মনে করি, প্রডাকশনগুলোও কম মানুষ দিয়ে করার একধরনের প্রবণতা দেখা যায়।’

তবে থিয়েটার থেমে থাকবে না। সে সামনে এগিয়ে যাবেই। অভিনেতা ও নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম বলেন, ‘থিয়েটার একটা আদিম শিল্পমাধ্যম। এটা সব সময় নানা কিছুর মুখোমুখি হয়েছে। যখন নগরায়ণ ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না, তখনো থিয়েটার চলেছে। থিয়েটার নানা ধরনের বাস্তবতাকে পেরিয়ে এসেছে। সেটা সামাজিক, বৈজ্ঞানিক, কারিগরিক—একেক সময় একেক রকম। এটাও একধরনের বাস্তবতা। এই বাস্তবতার মধ্যেই থিয়েটার হবে।’